অ্যামাজনে কেনাকাটা করতে চান? আসছে আন্তঃসীমান্ত ডিজিটাল বাণিজ্য
এলসি খোলা ছাড়াই বাংলাদেশে বসে বিশ্বজুড়ে যেকোন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পণ্য ও সেবা আমদানি-রপ্তানির সুযোগ রেখে আন্তঃসীমান্ত ডিজিটাল বাণিজ্য চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সব ধরনের আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশে ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে খুচরা ও বাল্ক আকারে পণ্য রপ্তানি করার পাশাপাশি আমদানিও করতে পারবে।
অ্যামাজন, আলীবাবা, বেস্টবাইসহ বিশ্বজুড়ে থাকা সব ধরনের বিদেশি ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে অনলাইনে খুচরা ও বাল্ক আকারে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে।
তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে খুচরা পর্যায়ে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে বিদেশি ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিটি নম্বর (ডিবিআই) গ্রহণ করতে হবে।
এসব বিধান রেখে 'ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্য নীতিমালা, ২০২৩' এর খসড়া তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে প্রচলিত রপ্তানিকারকরা যেভাবে রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা পেয়ে থাকেন, ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রণোদনাসহ বিভিন্ন ধরণের নীতি সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল ডিজিটাল কমার্স সেল এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাঈদ আলী টিবিএসকে বলেন, "ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্য নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি চূড়ান্ত করতে ঈদ উল আযহার পর বৈঠক হবে। খসড়াটি চূড়ান্ত হওয়ার পর মন্ত্রিসভার অনুমোদন শেষে এটি গেজেট আকারে জারি করা হবে।"
তিনি বলেন, "এ নীতিমালা কার্যকর হলে বাংলাদেশিরা যেমন বিদেশি ডিজিটাল প্লাটফর্ম থেকে পণ্য কিনতে পারবে, তেমনি বাংলাদেশি ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলোও বিদেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে।"
এলসির পাশাপাশি অনুরোধপত্র বা আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমেও ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্য করা যাবে।
তবে ক্রস-বর্ডার ট্রেডের ক্ষেত্রে সব ধরনের পেমেন্ট বাংলাদেশ ব্যাংক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিসেবার মাধ্যমে বা যেকোন ব্যাংকের মাধ্যমে হতে হবে।
কোভিডের সময় থেকেই বিশ্বজুড়ে বিজনেস-টু-কনজ্যুমার (বি২সি) এবং কনজ্যুমার-টু-কনজ্যুমার (সি২সি) ক্রস-বর্ডার বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ছে।
দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও বিভিন্ন সময় ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল ট্রেড চালুর প্রস্তাব দিয়েছে।
বাংলাদেশের লোকাল ব্র্যান্ডগুলোর তৈরি পোশাক ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে সরাসরি বিক্রি করতে অ্যামাজন, ই-বে এবং আলিবাবা.কমের মতো গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকা চেয়েছিল বিজিএমইএ।
এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বাণিজ্যের পরবর্তী পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এবং ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও আমদানি সহজীকরণ করতে ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল ট্রেড চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের সম্ভাবনা
২০২২ সালে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ৮২.৫০ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বৃদ্ধিই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল ট্রেড চালু হলে বিপুল পরিমাণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সরাসরি ক্রস-বর্ডারে যুক্ত হতে পারবেন।
ডিজিটাল বাণিজ্য সম্প্রসারণে দেশিয় লজিস্টিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিবহন ও ডেলিভারি কোম্পানিগুলোর সংযোগ ও সমন্বয় করা হবে।
পণ্য ও সেবা ডেলিভারির ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল লজিস্ট্রিক্স ট্রাকিং প্ল্যাটফর্ম (সিএলটিপি) চালু করা হবে। এই প্ল্যাটফর্ম সকল পেমেন্ট সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত থাকবে।
ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল ট্রেডের মাধ্যমে রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, রপ্তানি সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো সহজতর করে দেশি পণ্য ও সেবা রপ্তানিকে উৎসাহিত করা হবে। এমনকি ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্সেল রপ্তানির ক্ষেত্রে নীতিমালা সহজ করা হবে।
ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে রপ্তানির ক্ষেত্রে এলসির ছাড়াও অনুরোধ পত্র, বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হবে।
অনুরোধপত্র বা চুক্তির আওতায় রপ্তানির অর্থ দেশে আনার ক্ষেত্রে বা মূল্য সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ৬ মাস সময় দেওয়ার বিধান করা হবে।
"ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে রপ্তানির ক্ষেত্রে সাধারণ রপ্তানির মতো আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে ডিমড এক্সপোর্ট ও অন্ট্রাপোর্ট এক্সপোর্টকেও প্রণোদনার আওতায় আনা হবে,"- বলা হয়েছে এতে।
ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে রপ্তানির ক্ষেত্রে ভ্যাট রেয়াতসহ রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলোকে বিশেষ কর সুবিধা দেওয়া হবে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, রপ্তানি ত্বরান্বিত করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বাইরে প্রয়োজনীয় ওয়্যারহাউজ বা গোডাউন নির্মাণ করা হবে। ড্রপ শিপিং এবং অন্ট্রাপো এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেওয়া হবে। দেশে এবং দেশের বাইরে প্রয়োজনীয় মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতি-সহায়তা দেওয়া হবে।
এছাড়া, ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে রপ্তানির জন্য দেশের বন্দরগুলোর কাছাকাছি এলাকায় পণ্য ও সেবা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণের জন্য ডিজিটাল বাণিজ্য রপ্তানি অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। এসব অঞ্চল আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ইপিজেডগুলোর মতো সকল সুযোগ-সুবিধা পাবে।
যেকোন বিদেশি ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে অনলাইনে খুচরা পণ্য ও সেবা বিক্রি করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে ডিবিআই নিতে হবে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশের ভেতরে ডেলিভারির জন্য পণ্যের বাল্ক আমদানি করা যাবে। ডিজিটাল বাণিজ্য প্লাটফর্মের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্য সংরক্ষণের জন্য দেশের বন্দরগুলোর কাছাকাছি এলাকায় ওয়্যারহাউজ স্থাপন করা যাবে। আমদানি করা পণ্য ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে।
ডিজিটাল বাণিজ্যে রপ্তানি উদ্দেশ্যে আমদানি সহজ করাসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে আমদানির ক্ষেত্রে ডি-মিনিমিস ভ্যালু যৌক্তিকীকরণ করার কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে আমদানি করে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ব্যবহার করলে ইপিজেডের মতো সুবিধা পাওয়া যাবে।
তবে আমদানি করা পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে এনবিআর নির্ধারিত ভ্যাট ও ট্যাক্স দিতে হবে।
কোন বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে পণ্য ও সেবা বিক্রি করলে বিক্রয় পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেকোন বৈধ ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিক্রয়োত্তর সেবা দেওয়ার জন্য বিদেশি কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে।
বিদেশি ডিজিটাল বাণিজ্য কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশে পণ্যের বিজ্ঞাপন সম্পর্কে খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপন প্রচার সংক্রান্ত প্রচলিত আইন-কানুন মেনে দেশের অভ্যন্তরে কোন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিদেশি কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে।
আবার বিদেশি কোন পণ্য ও সেবা আমদানি করার পর দেশের অভ্যন্তরে অনলাইন প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে। তবে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে ভ্যাট, ট্যাক্সসহ অন্যান্য কর দিতে হবে।
সীমাবদ্ধতা
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশের আমদানি নীতি আদেশ ও রপ্তানি নীতিতে নিষিদ্ধ এমন কোন পণ্য কেনা-বেচা করা যাবে না।
কোন কল্পিত পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না। ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে লটারি, জুয়া, বেটিং ইত্যাদির আয়োজন বা এর টিকিটে বা টোকেন ইস্যু বা বিনিময় করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোন গিফট কার্ড, গিফট ভাউচার বা অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এমন কোন কার্ড বা ডিজিটাল নম্বর ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইক্যাব) এর সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তমাল টিবিএসকে বলেন, "বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে নীতিমালা করছে, তা কার্যকর হলে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পণ্য বিদেশের ক্রেতা-প্রতিষ্ঠানের কাছে সরাসরি রপ্তানি করা সম্ভব হবে।"
তিনি বলেন, "ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে বিদেশ থেকে অল্প অল্প পণ্যের অর্ডার আসে। সেগুলো এলসি ছাড়া পাঠাতে হয়। এতে উদ্যোক্তাদের খরচ অনেক বেড়ে যায়। আবার অ্যামাজনের মতো প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশি পণ্য পাঠালে পণ্যগুলো বিক্রির পর টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু পণ্যগুলো বিক্রি হচ্ছে কি-না, কী পরিমাণ হচ্ছে, তা বুঝার মতো সেন্ট্রাল কোন প্ল্যাটফর্ম নেই।"
"ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল ট্রেড নীতিমালা কার্যকর হলে এসব সমস্যা সমাধান হবে। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন প্লাটফর্মগুলোর সঙ্গে আমাদের লিয়াজো তৈরি হবে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে," বলেন তিনি।