উপসাগরীয় দেশগুলোতে ‘শেনজেন-স্টাইল ভিসা’ যেভাবে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে
উপসয়াগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপের মতো 'শেনজেন-স্টাইলের ভিসা' পদ্ধতি চালুর ব্যাপারে আলোচনা চলছে। এতে আগামী দিনে এসব দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন শ্রম রপ্তানিকারকরা।
এ ধরনের ভিসা পদ্ধতি চালু হলে পর্যটকরা এক ভিসা দিয়েই অঞ্চলের সব অংশীদার দেশগুলোতে ভ্রমণ করতে পারবেন। এতে ওই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা)- এর সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যত বেশি ট্যুরিস্ট মুভমেন্ট এবং বিজনেস মুভমেন্ট হবে, সেখানে ততবেশি কর্মের সুযোগ তৈরি হবে। এতে অবশ্যই আমাদের মতো শ্রমিক রপ্তানিকারক দেশগুলো লাভবান হবে। আশা করি, এটি আমাদের শ্রমবাজারে একটি ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।"
একক ভিসার বিষয়টি গত মে মাসে দুবাইয়ে অ্যারাবিয়ান ট্রাভেল মার্কেট (এটিএম) নামক ইভেন্ট চলাকালীন বাহরাইনের পর্যটন মন্ত্রী ফাতিমা আল সাইরাফি, সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি আবদুল্লাহ আল সালেহ এবং সৌদি পর্যটন কর্তৃপক্ষের সিইও ফাহাদ হামিদাদ্দিন ঘোষণা করেন। অ্যারাবিয়ান বিজনেস প্রকাশনা হোটেলিয়ার মিডল ইস্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
উপসাগরীয় দেশগুলো এই চেষ্টায় এগিয়ে আসলে তা ইতিবাচক হবে উল্লেখ করে বাহরাইনের পর্যটন মন্ত্রী আল সাইরাফি বলেন, "আমাদের বিশাল সুযোগ রয়েছে, প্রচেষ্টা চলছে কীভাবে জিসিসি (গলফ কো-অপরেশন কাউন্সিল) দেশগুলোকে একত্রিত করা যায়। ২০২২ সালে আমারা ৯.৯ মিলিয়ন পর্যটক পেয়েছি। কীভাবে? সে বছর আমাদের একটি বিশেষ উদ্যোগ ছিল, আমরা বাহরাইনকে জিসিসি-এর সাথে একীভূত গন্তব্য হিসেবে প্রোমোট করতে শুরু করি।"
আল সাইরাফি আরও জানান, আলোচনা চলমান ছিল এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য একটি শেনজেন-স্টাইলের ভিসা পদ্ধতি চালু করতে পারলে তা অত্যন্ত কার্যকরী হবে- এ বিষয়ে অনেকেই একমত।
উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে সহজ ভ্রমণ পদ্ধতি প্রত্যেক দেশেই পর্যটন বৃদ্ধি করবে; এবং দর্শনার্থীরা কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই এক ভিসায় বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করতে পেরে খুশিও হবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গেল বছর ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের সময় উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক এই ভিসা সহযোগিতার একটি সফল 'পাইলট পরীক্ষা' পর্যবেক্ষণ করা হয়।
বিশ্বকাপ চলাকালীন সমস্ত হায়া কার্ডধারীদের ৬০ দিনের ভিসা প্রদান করে সৌদি আরব।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বকাপের সময়ে এই সাফল্যের পর অনুরূপ আরও স্থায়ী ভ্রমণনীতি সম্পর্কে আলোচনার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে।
স্ট্যাটিস্তার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে প্রায় ২৮ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক উপসাগরীয় দেশগুলোতে ভ্রমণ করেছেন।
২০২১ সালে গলফ অঞ্চলের সংযুক্ত আরব আমিরাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক আন্তর্জাতিক পর্যটকের আগমন ঘটে; আর্থিক মূল্যের হিসাবে তা ১২ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
'ভিসা ফ্রি ওয়ার্ল্ড'-এর ধারণা থেকে সবাই লাভবান হবে উল্লেখ করে শামিম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, "আমরা ভিসার মাধ্যমে মানুষের চলাচলে বিধিনিষধ আরোপ করি। তবে ধীরে ধীরে পৃথিবী বুঝতে পারছে যে, এ ধরনের চলাচল (বাধামুক্ত) অর্থনীতি সচল হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।"
"ফ্রি মুভমেন্ট যত বেশি হবে, তত বেশি লোক যাওয়া-আসা করবে। অর্থনীতির উন্নতির জন্য কোভিড পরবর্তী সময়ে সৌদি আরবের মতো রেস্ট্রিকটেড দেশও ভিসিট সৌদি নামে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে," বলেন তিনি।
বাংলাদেশের পাসপোর্টের মান অনেক নিচে নেমে গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, "যদি এমন সুবিধা দেওয়া হয় যে, আমাদের কর্মীরা শুধু ইকামা দেখিয়েই কর্মস্থল থেকে গাল্ফের অন্য যেকোনো দেশে ঘুরে আসতে পারছে, তাহলে এটা তাদের চলাচলে সুবিধা বয়ে আনবে। তারা ছুটিতে অন্য দেশগুলোতেও ঘুরে আসতে পারবেন।"
একটি বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৫ মিলিয়নেরও বেশি বাংলাদেশি এখন উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ করছেন।
এরমধ্যে সৌদি আরবে রয়েছেন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী। সেদেশের বিভিন্ন সেক্টরে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন সেবাখাতে বর্তমানে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক জড়িত।
যদিও তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ক্লিনার বা এ ধরনের পদে কম বেতনে কাজ করছেন; সাকুল্যে তারা বেতন পান ২২,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা।
এরপরেও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স আয় করছে বাংলাদেশ। ২০২২ অর্থবছর এই দেশগুলো থেকে ১১.১২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা, যা ওই বছরের মোট রেমিট্যান্সের অর্ধেকেরও বেশি।
এদিকে, বায়রা'র মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী টিবিএসকে বলেন,"এই ভিসা পদ্ধতি চালু হলে কী পরিমাণ ট্যুরিস্ট মুভমেন্ট বাড়বে সেটা এখনো আমরা জানি না। তাই বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়ার ওপর প্রভাব নিয়ে এখনি মন্তব্য করা যাচ্ছে না।"
সৌদি ট্যুরিজম অথরিটির সিইও ফাহাদ হামিদাদ্দিনের মতে, জিসিসিভুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত, কাতার এবং বাহরাইন বিভিন্ন পর্যায়ে ভিসা নিয়ন্ত্রণ করছে; ফলে স্বাভাবিকভাবেই কঠিন হয়ে উঠেছে দেশগুলোর ভিসানীতি।
তিনি ভিসা সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য প্রতিটি জিসিসি দেশই একে অপরের পরিপূরক।