বাংলাদেশ-ভারত রেল কার্গো সংযোগের সম্ভাবনা যাচাই করছে এডিবি
বাংলাদেশের রেলপথ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং উপ-আঞ্চলিক রেলসংযোগের দীর্ঘকালীন অংশীদার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেলপথভিত্তিক মালামাল পরিবহনের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
অবকাঠামোগত ঘাটতি অনুসন্ধান, কার্গো ও কন্টেইনার পরিবহনে প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধানের পরামর্শ প্রদান, এবং দুই দেশের মধ্যে মালগাড়ি পরিচালনার জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্কারের সুপারিশের জন্য এ দাতাসংস্থাটি ইতোমধ্যে একটি সমীক্ষা শুরু করেছে।
এডিবি'র সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন প্রোগ্রাম-এর আওতায় ওই সমীক্ষায় নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট কার্গো পরিচালনার সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেলপথে মালামাল ও কন্টেইনার পরিবহন কতটুকু লাভজনক হবে, তাও হিসেব করা হবে এডিবি'র সমীক্ষাটিতে।
৩ প্রকার রেল ট্র্যাফিক
এডিবি'র একটি প্রতিনিধিদল ইতোমধ্যে গত ২৩-২৫ মে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্ভাব্য তিন ধরনের রেল চলাচল নিয়ে আলোচনা করেছেন। এগুলো হলো: দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়ীদের দুই দেশের রেল নেটওয়ার্ক ও বন্দরের ব্যবহার, এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে দেশটির বাকি অংশের অভ্যন্তরীণ কার্গো পরিবহন।
নেপাল, ভুটানকে রাখার পরামর্শ ঢাকার
এডিবি'র প্রস্তাবের বিপরীতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের গুরুত্ব উল্লেখ করে এ ধরনের রেল কার্গো নেটওয়ার্কে নেপাল ও ভুটানকে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। এছাড়া রেলভিত্তিক কার্গোর জন্য সীমান্তের দুই পাশের অংশীজনদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি উপযুক্ত ট্রানজিট ফি'র প্রস্তাবনা দেওয়ার জন্যও এডিবি'র সমীক্ষাদলকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এডিবি'র একটি নথিতে বলা হয়েছে, এ ধরনের রেল কার্গো ও কন্টেইনার পরিবহনের ধারণা বাস্তবায়ন সম্ভব কি না তার পক্ষে স্পষ্ট 'হ্যাঁ বা নাসূচক' বিশ্লেষণ জানাবে সমীক্ষাটির ফলাফল। এছাড়া বিভিন্ন পণ্য, সেগুলোর উৎস ও গন্তব্যের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা, এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত প্রকল্প ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ তালিকা প্রদান করা হবে ওই সমীক্ষার ফলাফলে।
রেলপথে কন্টেইনারে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পরিবহন ও লজিস্টিকস সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পাইপলাইনে থাকা বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে এডিবির সমীক্ষায় সুপারিশ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ওই বৈঠকে পদ্মাসেতু হয়ে চালু হওয়া নতুন রেলপথের কথাও এডিবি'র সমীক্ষায় বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সমীক্ষায় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের জন্য সুবিধাজনক একটি রোডম্যাপও থাকা উচিত বলে কর্মকর্তারা বৈঠকে উল্লেখ করেন। পুরোনো রেলপথগুলো নতুন করে চালু করা এবং আঞ্চলিক ট্রানজিট সংযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ভারতের অংশে না থাকা রেলপথগুলো নিয়ে কাজ করার গুরুত্বের ওপরও জোর দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার জানিয়েছেন, তারা এডিবিকে সমীক্ষায় আরও কিছু সীমাবদ্ধতাও বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
রেলভিত্তিক এ কার্গো পরিবহন প্রকল্পে এডিবি'র অর্থায়ন নিশ্চিত করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
অর্থায়ন করতে পারে এডিবি
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এডিবি কেবল সমীক্ষা করছে না, তার পরে সংস্থাটি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণেও অর্থায়ন করবে।
'এডিবি আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য দুটোই বাড়ানোর পৃষ্ঠপোষকতা করছে। আশা করা যাচ্ছে, রেলপথে বাণিজ্য বিস্তারে সংস্থাটি বিনিয়োগ করবে,' ওই কর্মকর্তা বলেন।
'নতুন সমীক্ষাটির মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত রেলওয়ে কার্গো-ভিত্তিক বাণিজ্যের জন্য কোন অবকাঠামোগুলো দরকার এবং তাতে কত ব্যয় হতে পারে – তা নির্ধারণ করা হবে। পরে এই সমীক্ষার ভিত্তিতে, তাদের ঋণ কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এডিবি'- যোগ করেন ইআরডির কর্মকর্তা।
এডিবির নথি অনুসারে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে মধ্য-মেয়াদি এই জরিপের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আওতায়, বেনাপোল, দর্শনা, রোহানপুর, বিরল, বুড়িমারীর মতো ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্টগুলোয় বিদ্যমান অবকাঠামোর অবস্থা পর্যালোচনা এবং রেলওয়ে নেটওয়ার্কের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করার লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়া প্রধান প্রধান স্টেশনগুলোর লুপলাইন, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং, মজুত অবকাঠামো ও মালামালের শেড উন্নতকরণ প্রস্তাবিত সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারত, নেপাল ও ভুটানে কি কি পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব – তাও এই অধ্যয়নের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হবে।
এডিবি টিম মনে করছে, ভারত ও নেপালের মধ্যে কন্টেইনার পরিবহনে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক কার্গো ট্র্যাকিং সিস্টেম (ইসিটিএস) এর অনুকরণ – বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার রেলপথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও করা সম্ভব।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেলপথে মালামাল পরিবহনের উদ্যোগ উভয় দেশের জন্য বিপুল সম্ভাবনাময় হতে পারে বলেছেন বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করেন, রেলপথের বর্তমান অবকাঠামোর পাশাপাশি এডিবির চলমান উদ্যোগ সফল হলে – এই পরিবহনের মাধ্যমে নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হবে, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে অবদান রাখবে।
ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, অনেকদিন ধরেই ভারতের সাথে রেল কার্গো-ভিত্তিক বাণিজ্যিক সংযোগ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বর্তমানে সামান্য পরিমাণ পণ্য রেলপথে বহন করা হচ্ছে, যা আরও সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে।
'যদি রেলপথে মালবহনের মাধ্যমে আরও বাণিজ্য করা যায়, তাহলে আমদানি ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যদ্রব্যের দাম অনেকটাই কমে আসবে। এতে হ্রাস পাবে আমদানি-রপ্তানির সময়, যার সুবিধাভোগী হবে উভয় দেশ'- যোগ করেন তিনি।
তবে রেলে মালামাল বহন-ভিত্তিক এই বাণিজ্যের জন্য কোন রুটগুলো উপযুক্ত তা সমীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে এবং সে অনুসারে কাস্টমস পয়েন্টগুলোর উন্নয়ন করতে হবে বলে উল্লেখ করেন এই বাণিজ্য নীতি বিশ্লেষক।
যদি নিয়মিত রেল কার্গো-ভিত্তিক বাণিজ্য চালু করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ট্রানজিটের সুযোগ বাড়বে বলেও যোগ করেন তিনি।
এদিকে ট্রান্সশিপমেন্ট এড়িয়ে তৃতীয় দেশে সরাসরি পণ্য রপ্তানির জন্য ভারতীয় বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব ভারত বাংলাদেশকে দিয়েছে। দেশের পোশাক ও অন্যান্য পণ্যের কিছু রপ্তানিকারক এই সুবিধা গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে এডিবি মিশনকে জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।
ভারতে ট্রেন যাওয়ার অনুমতি এনবিআরের
২০২২ সালের নভেম্বরের আগপর্যন্ত, একমুখী ট্রেন চলাচলের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেলপথে বাণিজ্যের পাল্লা অনেকটাই ঝুঁকেছিল ভারতের দিকে। তবে গত বছরের ৪ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেনাপোল থেকে বাংলাদেশি পণ্যবাহী ট্রেনগুলোকে ভারতে ফিরতি যাত্রার অনুমতি দেয়। এতে বাণিজ্যের গতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সূচনা হয়।
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, ব্যবসায়ীদের স্থলবন্দর-ভিত্তিক বাণিজ্যের জটিলতা থেকে মুক্তি দিয়ে পূর্ণমাত্রার রেল কার্গো-ভিত্তিক বাণিজ্য বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশকে লাভবান করবে।
পোশাক খাতের এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, 'বর্তমানে সামান্য পরিমাণ পণ্য ভারত থেকে রেলপথে ভারত থেকে আসে। প্রতিবেশী দেশটি থেকে আমাদের মোট আমদানির তুলনায় যা নগণ্যই বলা যায়। অন্যদিকে, রেলযোগে বাংলাদেশের তেমন কোনো রপ্তানি-ই নেই।' অর্থনীতির স্বার্থেই রেলপথে আমদানি-রপ্তানির ব্যবস্থা থাকা উচিত বলেও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
হাতেম বলেন, বেনাপোল, দর্শনা, হিলি ও আখাউড়া – এই চার রুটে অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে রেলকার্গো-ভিত্তিক বাণিজ্য সংযোগ চালু করা সম্ভব।
ট্রেনে কাঁচামাল আমদানি চায় ইউনিলিভার
৪০ শতাংশ কাঁচামালের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল ইউনিলিভার বাংলাদেশ। গত দুই বছর ধরে কোম্পানিটি ট্রেনে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশকে রাজি করানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছিল।
২০২০ সালের জুলাইয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনিলিভার বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কেদার লেলে বলেন, 'পাইকারিভাবে কাঁচামাল পরিবহনে বাংলাদেশ কেন রেলপথ ব্যবহার করছে না? এতে সড়কে যানবাহনের চাপ অনেকটাই দূর হবে।'
সে বছরের জুলাইয়ে ওই সাক্ষাৎকারের দুই সপ্তাহ আগে অবশেষে তাদের দাবি পূরণ হয়। এসময় ভারত থেকে আসা একটি ট্রেনে করে দরকারি ১,২০০ টন কাঁচামাল আমদানি করে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। প্রায় ২২টি বগিতে বোঝাই হয়ে আসে কোম্পানিটির কাঁচামাল, যা সড়কপথে পরিবহন করলে দরকার হতো ৬০টি ট্রাক।
একইবছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্পের জন্য এক সহায়ক উদ্যোগ হিসেবে প্রথমবারের মতো ৪৬৮ টন সুতা বেনাপোল থেকে রেলপথে আসে। ফলস্বরূপ, দ্বিপক্ষীয় রেল বাণিজ্য ১৩০ শতাংশের মতো নজিরবিহীন বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বলে জানায় ঢাকায় ভারতের হাই-কমিশন।
কোনো ট্রানজিট ফি নেই
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো ড. মোহাম্মদ ইউনুসও মনে করেন, রেলপথে মালামাল বহনের ফলে ব্যবসার খরচ কমবে, যার সুবিধাভোগী হবেন যা দুই দেশের ব্যবসায়ীরা।
রেলপথে মালবহনে রেলওয়ের ট্রানজিট ফি আরোপের প্রস্তাবের বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র বিধিমালা অনুসারে, কোনো ট্রানজিট ফি প্রযোজ্য হবে না। বরং বাংলাদেশের ভুখণ্ডের মধ্যে ভারতীয় ট্রেন চলাচলের সময় যদি কোনো ক্ষতি হয়, তা পোষাতে দীর্ঘমেয়াদি ন্যূনতম একটা চার্জ নেওয়া যেতে পারে।