দুর্নীতির কারণে বিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ পাচ্ছে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান: আইএমইডি
সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক লবিংয়ের সুযোগ নিয়ে বিদ্যুৎ খাতে প্রকল্পে অযোগ্য সরবরাহকারীরা কাজ পাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে আইএমইডি'র এক প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলেতেও নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবাহের কারণে বিদ্যুৎ খাতের লোকসান ক্রমগত বেড়ে চলছে।
দুর্নীতির কারণে অনেক প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রকল্পের মেয়াদ। এতে প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।
আইএমইডির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মন্ত্রণালয়, সচিবালয় কেন্দ্রীক ক্রয় কমিটি, সিপিটিইউ (সেন্টার প্রকিউমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) একদল দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা সরকারি ক্রয় আইন ও ক্রয় বিধিমালার দোহাই দিয়ে বিদ্যুৎ খাতকে অযোগ্য (মূলত চীনা ও ভারতীয়) সরবরাহকারীদের 'পুনবার্সন কেন্দ্র' বানিয়ে ফেলেছে।
"উন্মুক্ত দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়ার নাম করে, বিদ্যুৎ খাতে যাবতীয় নিম্নমানের যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ, নিশ্চয়তাহীন মেশিন ঢুকে গেছে। খুচরা যন্ত্রাংশ ও সাপোর্ট সিস্টেমের নামে ব্যালেন্স অব প্ল্যান্ট (বিওপি) খাতে খরচ হয়ে যাচ্ছে শত কোটি ডলার," বলা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, "রাজনৈতিক লবিং এবং অযোগ্য ভেন্ডরের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কারণে (গ্যারান্টিহীন এফজিএমও) বড় ধরনের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণে আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলে (এএফআর) বাস্তবায়ন না থাকায় ডিষ্ট্রিবিউশনের লোডও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্ট্রোল করা সম্ভব হয় না স্বয়ংক্রিয়ভাবে।"
বিদ্যুৎ বিভাগের বড় প্রকল্পগুলো সাধারণ টার্ণ-কী পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হয়। এতে দেখা যায় বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে। ঠিকাদার সংস্থার ইচ্ছা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা হয়ে থাকে বলে প্রতিবেদনে বলা উল্লেখ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইএমইডি বলছে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কোন কর্মকর্তার অবহেলা, দুর্নীতি, সময়ক্ষেপণ বা অন্য কোনো অসদুপায়ের কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা কিংবা ব্যয় বৃদ্ধি পেলে উক্ত কর্মকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দিতে আওতায় আনতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, "বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বড় সমস্যা হলো দক্ষ জনবল এবং অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের বদলির ভুল পলিসি, স্বয়ক্রিয় সিস্টেম (স্ক্যাডা) না থাকা ।
বহু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বয়ংক্রিয় কন্ট্রোল করার জন্য অটোমেটিক জেনারেশান কন্ট্রোল (এজিসি) কিংবা ফ্রি গভর্নর মুড অপারেশন (এমজিএমও) বাস্তবায়ন নেই।
সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাত বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি। এসব সমাধানে দরকার মেধাবী, দূরদর্শী, ভবিষ্যতমুখী স্বচ্ছ ও দায়বন্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ বিভাগের চলমান ৬৭টি প্রকল্পের অগ্রগতি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওয়াধীন দপ্তরগুলোর প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি হতাশাব্যাঞ্জক।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চলমান ১২ প্রকল্পের মধ্যে ৭টির বাস্তবায়ন মেয়াদ ইতোমধ্যে ৭ থেকে ৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্ত এসব প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৭৪%।
একটি প্রকল্প ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে, কিন্তু এর অগ্রগতি মাত্র ৩০.৮৬%।
পিজিসিবির ১৭ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ ৭ থেকে ৯ বছর ধরে চললেও ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৫১%। এই সংস্থার ৬টি প্রকল্প ৪-৬ বছর ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে, যেগুলোর বাস্তব অগগতি ৫০%।
একইভাবে পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ৬ প্রকল্পে ৪-৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৪৮%।
এছাড়া ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাডিকো, ইজিসিবি, এসপিসিএল, সিপিজিসিবিএ ও স্রেডার বাস্তবায়ন অগ্রগতিও হতাশাব্যাঞ্জক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিদ্যুত প্রকল্পগুলো প্রায়শই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে ৩০০% বা তার বেশি টাইম ওভার রান হয়।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজের গতির সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রিড উপকেন্দ্র ও সঞ্চালন নির্মাণ কাজ যথাসময়ে সমাপ্ত হয়না। এতে সময়মতো পাওয়ার ইভ্যাকুয়েশন সুবিধা সৃষ্টি করা যায় না।
দেখা যায়, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের লিমিডেটের (পিজিসিবি) প্রকল্পে ধীর গতির কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হওয়ার পরেও সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্ভব হয় না।
আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট (উত্তর) প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম জেলায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজের গতির সঙ্গে সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজের সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা না করে অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প নেওয়ার কারণে কখনো প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
প্রকল্প দপ্তরের অদক্ষতার কারণেও প্রকল্পের কাজের গতি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়।
বিপিডিবির বাস্তবানাধীন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় দ্বিতীয় ব্লকের ভূমি উন্নয়ন সংরক্ষণ ও সীমানা দেয়াল নির্মাণ প্রকল্পে সব কেনার কাজ সরাসরি পদ্ধতিতে করার পরেও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হয়নি।
এছাড়া একই কারণে সোলার স্ট্রীট লাইটং গ্রোগ্রাম ইন সিটি কর্পোরেশন প্রকল্পের কাজে ৫ বছরে মাত্র ১২% আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে।