লোকবল ঘাটতি সত্ত্বেও চাকরি হারালেন রেলওয়ের প্রায় ৮ হাজার অস্থায়ী কর্মী
চলতি বাজেটে (২০২৩-২৪ অর্থবছর) অস্থায়ী কর্মীদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই উল্লেখ করে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে রাষ্ট্র-চালিত রেল পরিবহন সংস্থা। তীব্র জনবল ঘাটতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় ৮ হাজার অস্থায়ী কর্মী জুলাইতে চাকরি হারিয়েছেন।
রেলওয়েতে বর্তমানে ৪৭ হাজার ৬৩৭ জনবলের অনুমোদন রয়েছে। এর বিপরীতে কর্মরত আছে প্রায় ২৫ হাজার। বাকি প্রায় ২২ হাজার পদ শূন্য।
উচ্চ আদালতের অন্তত ছয়টি রায়ে রেলওয়ের প্রায় এক হাজারেরও বেশি অস্থায়ী কর্মচারীকে স্থায়ী করতে বলা হয়। সেই আলোকে বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করা হয়।
কিন্তু তা বাস্তবায়ন না করে নতুন নিয়োগের পথে হাটছে রেলওয়ে। ফলে ক্ষুব্ধ দীর্ঘদিন ধরে রেলে কর্মরত অস্থায়ী শ্রমিকেরা।
অস্থায়ী কর্মচারীদের অভিযোগ— আইন অনুযায়ী নিরবিচ্ছিন্নভাবে তিন বছর অস্থায়ী পদে কর্মরতদের রাজস্ব খাতে স্থায়ীকরণের নিয়ম রয়েছে। অস্থায়ী বা টেম্পোরারি লেবার রিক্রুটমেন্ট (টিএলআর) কর্মচারীদের কেউ কেউ ১০ বছরও রেলে কাজ করছেন। তাদের বেশিরভাগের নতুন করে চাকরিতে আবেদনের বয়স নেই।
রেলওয়ে অস্থায়ী কর্মচারী ঐক্য পরিষদ ও টিএলআর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রেলওয়ের অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ী করতে আদালতের রিট পিটিশনে অন্তত ছয়টি রায় কর্মচারীদের পক্ষে এসেছে। এতে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক রয়েছেন।
এছাড়া আরো আড়াই হাজার অস্থায়ী কর্মচারীর করা অন্তত ১৫টি মামলা আদালতে বিচারাধীন।
আদালতের রায় অনুযায়ী, কর্মচারীদের স্থায়ীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হলেও অজানা কারণে তা আবার থমকে গেছে। তা বাস্তাবায়ন না করে উল্টো প্রকল্পের শ্রমিকদের নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংস্থাটি।
রেলওয়ের তথ্যমতে, প্রায় ৮ হাজারের বেশি অস্থায়ী কর্মী গেইটকিপার, পি-ম্যান, ওয়েম্যান, খালাসীসহ বিভিন্ন পদে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। দৈনিক ভিত্তিতে তাদের মজুরি ৫০০-৫৭৫ টাকা পর্যন্ত।
রেলের জনবল সংকট দীর্ঘদিনের। জনবল সংকটে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদগুলো টেম্পোরারি লেবার রিক্রুটমেন্ট-টিএলআর (কাজ নেই, মজুরি নেই) ভিত্তিতে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে চলছে রেল।
২০২০ সালে প্রণীত রেলের নিয়োগবিধিতে অস্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে আউটসোর্সিংয়ের (চুক্তিভিত্তিক) পরিকল্পনা করা হয়। গত বছর এ লক্ষ্যে হিসাব শাখা থেকেও টিএলআর কর্মচারী ছাটাই করে আউটসোর্সিং করা হয়। আউটসোর্সিং পদ্ধতি অর্থাৎ ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিকদের কাজে নিয়োজিত করা হবে। যেন পরবর্তীতে তারা স্থায়ী নিয়োগের দাবি তুলতে না পারেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে টিএলআর (অস্থায়ী) ঐক্য ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, "হাজার শ্রমিকের মাথায় হাত। শ্রমিকদের ডেকে বলা হয়েছে, তাদের জন্য আর কোন বেতন-ভাতা নেই বাজেটে। তিন-চার মাস লাগবে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ দিতে। এসময়টুকু কাজ করলেও কোন বেতন পাবে না। কর্তৃপক্ষ বলছে, ঠিকাদারদের অনুরোধ করা হবে টিএলআরদের কাজে রাখার বিষয়ে।"
গেইটকিপার সংকটের কারণে ২০১৬ সালে মানোন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে দুই অঞ্চলে প্রায় ১৮০০ চুক্তি-ভিত্তিক গেইটকিপার নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রায় ১৫০৫ জন কর্মরত আছেন। দীর্ঘ সময় নিয়োজিত অস্থায়ী কর্মচারীদের নিয়োগ না দিয়ে নতুন করে এই প্রকল্পের শ্রমিকদের নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংস্থাটি।
প্রকল্পের নিয়োগকৃত গেইটকিপার/গেইটম্যানদের রাজস্বভুক্ত স্থায়ী শূন্য পদে নিয়োগের জন্য গত ১০ মে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে রেলওয়ে। এতে ২ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে পূর্ণ হওয়া প্রকল্পের শ্রমিকদের আবেদনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। অথচ ৩ বছর থেকে শুরু করে ১০ বছর পর্যন্ত রেলওয়েতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার পরও রেলওয়ে এসব অস্থায়ী শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে না।
কিন্তু রেলের ২০২০ সালে প্রণীত ক্যাডার বহির্ভূত কর্মচারী নিয়োগের নীতিমালায় প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের রাজস্বখাতে স্থায়ী করার সুযোগ নেই। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ দীর্ঘসময় ধরে কর্মরত অস্থায়ী কর্মচারীরা। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের রায়ও উপেক্ষা করা হচ্ছে।
বর্তমানে রেলের মোট ৫৮৪১টি দাপ্তরিক পদের মধ্যে মাত্র ২৩৯৫টি পদে জনবল রয়েছে। বাকি ৩৪৪৯টি পদ শূন্য। ৫৩৪টি গার্ড পদের মধ্যে ২০১টি পদ শূন্য এবং পয়েন্টম্যানের ১৬৮৬টি পদের মধ্যে ৯০৮টি পদই শূন্য।
রেলওয়ের নথিপত্রের তথ্যমতে, সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক রিট পিটিশন রায়ের পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ৯৬ জন অস্থায়ী কর্মচারীকে শূন্য পদে আত্মীয়করণের কার্যক্রম শুরু করেছিল রেলওয়ে।
তাদের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ২০২২ সালের অক্টোবর রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সংস্থাপন বিভাগ একটি কমিটিও গঠন করে। এরপর রেলের আইন কর্মকর্তার পাশাপাশি পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকও নিয়োগের বিষয়ে অনুমোদন দেন। কিন্তু অদূশ্য কারণে তাদের নিয়োগ হয়নি এখনো।
২০১৮ সালে করা রিট পিটিশন রায়ে ৭ জন শ্রমিককে স্থায়ী নিয়োগ দিতে বলা হয়। ২০২১ সালে রেলের পূর্বাঞ্চল কমিটি গঠনসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও নিয়োগ ঝুলে আছে ।
বাংলাদেশ রেলওয়ে টিএলআর (অস্থায়ী) ঐক্য ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, "সরকারি আদেশ, উচ্চ আদালতের রায় মেনে রাজস্ব খাতে নিয়োজিত অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ী নিয়োগ দিতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। কিন্তু রেলওয়ে সরকারি আদেশ কিংবা আদালতের রায় অমান্য করে দিনের পর দিন অস্থায়ী শ্রমিকদের বঞ্চিত করছে। আমরা ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চতর পর্যায়ে যোগাযোগ করেছি। ধর্মঘটের মতো কর্মসূচিও দিয়েছি। আমরা চাই রাজস্ব খাতের অস্থায়ী কর্মীদের নিয়োগের পর ক্রমান্বয়ে যাতে প্রকল্পের শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়।"
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, "রেলওয়ের অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের বিষয়টি আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রক্রিয়াধীন। রেলওয়ের আইন শাখার অনুমোদন সাপেক্ষে স্থায়ীকরণের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে একাধিক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। নতুন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জরুরী ভিত্তিতে কিছু চতুর্থশ্রেণির শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হবে। এর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পুরোনো টিএলআর কর্মীদের স্থায়ীকরণের সম্পর্ক নেই।"
রেলওয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ওয়ার্কশপ, ম্যাকানিক্যাল, সিগন্যাল ইলেকট্রিক্যাল, ট্রান্সপোর্টেসন্স, গেইটকিপার, পোর্টার, অপারেটিং পরিচালনার কাজে দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দক্ষ জনবল পাওয়া না গেলে বিপর্যয় নেমে আসবে পুরো রেল খাতে। এ বিষয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়ে গত বছরের ১৩ জুন রেল সচিবকে চিঠি দিয়েছিলেন রেলওয়ের মহাপরিচালক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাজেটে টিএলআরদের জন্য কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন পেলে আউটসোর্সিংয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে। এসময়টুকুতে যাদের প্রয়োজন শুধু তাদের রাখতে বলেছে কর্তৃপক্ষ।"