উদ্ধারের অপেক্ষায় পানগাঁও এক্সপ্রেস, কোটি কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা আমদানিকারকদের
বৈরি আবহাওয়ার কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়া চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনারবাহী জাহাজ এমভি পানগাঁও এক্সপ্রেস গত এক সপ্তাহের বেশি সময়েও উদ্ধার হয়নি। ফলে জাহাজের ৯৬ টিইইউএস (টুয়েন্টি ফুট ইক্যুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কন্টেইানারে থাকা প্রায় ৭০ কোটি টাকার পণ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন আমদানিকারক ও শিপিং কোম্পানিগুলো।
পানগাঁও এক্সপ্রেসের চার্টার কোম্পানি সি গ্লোরি শিপিং, কনটেইনারসহ জাহাজটি উদ্ধারের জন্য এক্সন-জেনুইন জেভির সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
রোববার থেকে শুরু হবে উদ্ধার অভিযান। উদ্ধার পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে কন্টেইনারগুলো তুলে আনা হবে; এরপর আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ডকে নিয়ে আসা হবে পানগাঁও এক্সপ্রেসকেও।
সি গ্লোরির ব্যবস্থাপক মাইনুল হোসেন জানান, দুর্ঘটনাস্থলের আশেপাশে আবহাওয়া খারাপ থাকায় সম্পূর্ণ উদ্ধার প্রক্রিয়া কবে নাগাদ শেষ করা যাবে তা এখনও অনিশ্চিত।
ভাসানচর দ্বীপের কাছে সন্দ্বীপ চ্যানেলে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সি গ্লোরি, উদ্ধারকারী কোম্পানি এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের আগে জাহাজটি উদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, "পাঁনগাও এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও জাহাজটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে, উদ্ধারকার্যে আমাদের সক্ষমতা আসলে কতটুকু।"
আর্থিক ক্ষতি
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে কেরানীগঞ্জের পাঁনগাও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনালে যাওয়ার পথে ভাসনচরের কাছে ৯৬টি কন্টেইনারসহ গত ৬ জুলাই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে জাহাজটি।
এ ঘটনায় জাহাজের তিনটি কন্টেইনার ডুবে যায়।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারের কর্মকর্তারা জানান, আমদানিকারকরা তাদের পণ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন এবং প্রতিনিয়ত জাহাজটির উদ্ধার সম্পর্কিত তথ্য জানতে চাচ্ছেন।
এদিকে, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমএইএ)-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, পানগাঁও-চট্টগ্রাম রুটে পরিবহন হওয়া বেশির ভাগ পণ্য কটন বা সুতার কাঁচামাল এবং কিছু বাণিজ্যিক আমদানি পণ্য। প্রতি টিইইউএস কন্টেইনারে গড়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার পণ্য থাকে। সেই হিসেবে ৯৬ টিইইউএস কন্টেইনারে সর্বোচ্চ ৭০ কোটি কোটি টাকার পণ্য থাকতে পারে।
পানগাঁও এক্সপ্রেসের চার্টারার সি গ্লোরি শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন জুয়েল বলেন, "এই মুহূর্তে জাহাজ উদ্ধার করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। উদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।"
জাহাজ এবং পণ্যের বিমা করা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
পানগাঁও এক্সপ্রেস ক্রয়
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কেরানীগঞ্জের পাঁনগাও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনালে পণ্য পরিবহনের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে ৫০ কোটি টাকায় পানগাঁও এক্সপ্রেস, পানগাঁও সাকসেস এবং পানগাঁও ভিশন নামে তিনটি পুরোনো জাহাজ কেনে।
জাহাজ ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট মেরিন ট্রাফিকের তথ্য অনুসারে, পানগাঁও এক্সপ্রেস এবং পানগাঁও সাকসেস ২০০৪ সালে নির্মিত হলেও পানগাঁও ভিশন নির্মিত হয় ২০০১ সালে।
তবে এ সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পুরনো জাহাজ তিনটির প্রকৃত দাম ২০ কোটি টাকা দাবি করে জাহাজ কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ তোলে।
কমিটির সদস্য আব্দুল লতিফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি সংসদ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় জাহাজ কেনার দুর্নীতির বিষয়টি উঠে আসে।
ওই বৈঠকে উত্থাপিত অভিযোগে বলা হয়, সকল নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে ২০ কোটি টাকার পুরোনো তিনটি জাহাজ ৫০ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে।
চীন থেকে পুরাতন জাহাজ কোনোভাবে জোড়াতালি দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি, যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরে এরকম পুরাতন জাহাজ কেনার কোনো ইতিহাস নেই।
এই অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কমিটি আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বলে জানান নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এম আব্দুল লতিফ।
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক জাহাজ কেনায় দুর্নীতির প্রসঙ্গে টিবিএসকে বলেন, "এ বিষয়ে আমার জানা নেই। বিষয়টি জেনে পরবর্তীতে বলতে পারবো।"
পানগাঁও এক্সপ্রেসের কার্যক্রম
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, শুরুতে বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জাহাজ তিনটি পরিচালনা করতো বন্দর।
পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর মাসিক ৪২ লাখ টাকা ভাড়ায় জাহাজ তিনটি সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। উভয়পক্ষের মধ্যে ৫ বছরের চুক্তি হয়।
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট বন্দরের কাছে হস্তান্তর করে জাহাজগুলো। ২০১৭ সালের শেষদিকে জাহাজ তিনটির চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
২০২২ সালের এপ্রিলে চতুর্থবারের মতো ওপেন টেন্ডার অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে সর্বাধিক জাহাজ পরিচালনকারী সংস্থা সি গ্লোরি শিপিং এজেন্সি বিয়ারবোর্ট চাটার্ড চুক্তির আওতায় জাহাজ তিনটি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। প্রতিটি জাহাজের জন্য মাসিক সাড়ে ৭ লাখ টাকা হিসেবে ৫ বছরের জন্য চুক্তি হয়। জাহাজ তিনটি মেরামত শেষে এমভি পানগাঁও এক্সপ্রেস গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে চলাচল শুরু করে। পরবর্তীতে বাকি জাহাজ দুটিও এই রুটে যুক্ত হয়।