ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন সম্পূর্ণরূপে ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত
আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথকে ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করার কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মাধ্যমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৩২৭ কিলোমিটার রেল লাইনের পুরোটাই ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত হচ্ছে।
এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম অংশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আগামীকাল (২০ জুলাই) রেললাইনটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রেলের কর্মকর্তা, গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা বলছেন, ডাবল লাইন চালুর ফলে নিরবিচ্ছিন্ন ট্রেন পরিচালনা, ট্রেনের গতি বৃদ্ধি ও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে।
তবে এই সুযোগ শতভাগ কাজে লাগাতে রোলিং স্টক বৃদ্ধির পাশাপাশি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) নির্মাণে গতি আনার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানান, ডাবল লাইন চালুর ফলে কোনো ট্রেনের ক্রসিং দিতে অন্য ট্রেনকে কোনো স্টেশনে বসে থেকে সময় নষ্ট করতে হবে না। এর ফলে ট্রেনের গতি বৃদ্ধির মাধ্যমে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সময় ও ব্যয় কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, "ডাবল ট্র্যাক চালু হলে এই লাইনে ট্রেন পরিচালনার সক্ষমতা দ্বিগুণে উন্নীত হবে।"
এছাড়া, রোলিং স্টকের প্রাপ্যতা বিবেচনায় ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সড়ক পথের তুলনায় রেলপথে পণ্য পরিবহন তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ হলেও লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে রেলপথে ব্যবসায়ীরা পণ্য পরিবহন করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, "সিঙ্গেল ট্যাক রেলপথে মালবাহী ট্রেনকে বিভিন্ন স্টেশনে অন্য ট্রেনকে জায়গা করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখা হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করা গেলে এই সমস্যার সমাধান হবে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে রেলপথে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য বাড়বে।"
তবে ব্যবসার বিকাশ নিশ্চিত করতে লাইনের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য সক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।
তিনি বলেন, কমলাপুর আইসিডির সক্ষমতা একেবারেই কম। তাছাড়া যানজটের কারণে এখান থেকে ট্রাকে করে পণ্য নিয়ে যাওয়াও সময় সাপেক্ষ। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ডুয়েল ট্র্যাকের শতভাগ সুবিধা পেতে ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মাণের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, প্রকল্পের মূল কাজ শেষ হয়ে গেলেও লুপ লাইনের কিছু কাজ এখনও বাকি রয়েছে। এর ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আর কোনো সিঙ্গেল লাইন থাকছে না।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) এই অংশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
পুরো প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হলে জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন প্রকল্প পরিচালক। এই করিডোরে ট্রেন পরিচালনার সক্ষমতা ৩৬ জোড়া থেকে বেড়ে ৭২ জোড়ায় উন্নীত হবে বলেও তিনি জানান।
তিনি বলেন, "এই ৭২ কিলোমিটার ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত হলে ট্রেনভেদে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘন্টা সময় সাশ্রয় হবে।"
কার্গো পরিবহনে সম্ভাব্য সুবিধা
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছর বন্দরে ৩.১ মিলিয়ন টিইইউ (বিশ ফুট সমতুল্য ইউনিট) কন্টেইনার পরিচালনা হয়েছে।
বিপরীতে, কমলাপুর আইসিডিতে হয়েছে মাত্র ৪৬,৭৬৫ টিইইউ, যা বন্দরে মোট কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের মাত্র ১.৫৬ শতাংশ।
স্টেকহোল্ডাররা মনে করেন, এই রেলওয়ের অবকাঠামো উন্নত হলে রেলপথে বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হওয়া প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানি ঢাকা এবং এর আশেপাশের অঞ্চলের উদ্দেশ্যেই হয়।
কর্তৃপক্ষ জানায়, কমলাপুর আইসিডি এর আগে বার্ষিক ৯০,০০০ টিইইউ এর পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে রেলপথে পণ্য পরিবহন কমে গেছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ মনে করেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনকে ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করলে রেলপথে পণ্য পরিবহনের নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
তিনি পরামর্শ দেন, কর্তৃপক্ষের উচিত কমলাপুর আইসিডির সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; নতুন আইসিডি নির্মাণ করা এবং উন্নত ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল রুটকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে ওয়াগনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।
"আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে পরিচালিত হয়। কয়েক বছর আগেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ওয়াগনের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চট্টগ্রাম থেকে পণ্য ঢাকায় আসত। এটা এখন অনেক কমে গেছে," বলেন তিনি।
অতীতে প্রতিটি মালবাহী ট্রেনে ৩০-৪০টি করে ওয়াগন থাকতো; প্রতিটির ধারণক্ষমতা ছিল ৩০-৩২ টন; তবে এখন এ ধরনের ওয়াগনের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রকল্পের বিস্তারিত
সূত্র জানায়, ৬,৫০৪.৫৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে 'আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেল লাইনকে ডুয়েলগেজে রুপান্তর' শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলছে।
এই প্রকল্পে প্রায় ৫,৪৭৭.৮৮ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ গুটিয়ে আনার কথা থাকলেও প্রকল্পের পরিধি বৃদ্ধি, ঠিকাদার নিয়োগ এবং কাজ শুরুতে বিলম্ব আর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধার কারণে প্রকল্পটির মেয়াদ গত জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, "ছোটখাট কিছু কাজ শেষ করার পাশাপাশি ঠিকাদারের এক বছর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি ধরে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।"
তবে মেয়াদ বাড়লেও প্রকল্পের ব্যয় না বেড়ে কিছুটা কমে আসবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রকল্পটির আওতায় প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে ১৪৪ কিলোমিটার মেইন লাইনের পাশাপাশি ৪০.৬০ কিলোমিটার লুপ ও সাইড লাইন নির্মাণ করা।
এছাড়া ১৩টি মেজর সেতু, ৪৬টি মাইনর সেতু ও ১১টি স্টেশনের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে প্রকল্পের আওতায়। এসব স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়নেও কাজ করা হয়েছে।
রেল পথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এর আগে ২০০৬ সাল থেকে কাজ শুরু করে ২০১৮ সালে টঙ্গী থেকে ভৈরব বাজার পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করা হয়। এর ফলে এই করিডোর পাড়ি দিতে আন্তনগর ট্রেনের ৩০ মিনিট সাশ্রয় হয়েছে।
একইভাবে, ২০১৮ সালে লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করার সুবাদে এই ৬১ কিলোমিটার রেলপথের গড় গতি ৩৮ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ঘন্টায় ৬৫ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে।
একই বছরে ভারতীয় ঋণে নেওয়া প্রকল্পের আওতায় সংযোগ রেলপথসহ ভৈরব বাজার দ্বিতীয় রেল সেতু ও তিতাস দ্বিতীয় রেলসেতু মিলে মোট ১১.৩২ কিলোমিটার ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করা হয়। এর ফলে আখাউড়া-লাকসাম অংশ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে করিডোরের পুরোটাই ডাবল লাইনে উন্নীত হয়।