পানির তলায় চট্টগ্রাম: ড্রেনে পড়ে নিহত ১, রাস্তায় চলছে নৌকা
কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী নিপা পালিত সোমবার বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু তার আর পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছানো হয়নি।
ডুবে যাওয়া একটি রাস্তা পার হওয়ার সময় ২২ বছর বয়সী এ শিক্ষার্থী ড্রেনে পড়ে মারা যান।
নিপার মৃত্যুর মাধ্যমে সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণে বন্দরনগরীতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল।
আবহাওয়াবিদদের মতে, সোমবার (৭ আগস্ট) বিকেল ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে প্রায় ২১৬ মিলিমিটার (প্রায় ৯ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ফলে পানির নিচে চলে গেছে বড় সড়ক ও গলিপথ, স্থবির হয়ে পড়েছে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।
জানা গেছে, অনেকে ডুবে যাওয়া সড়কে মাছ ধরেছেন, ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা শহরের মাঝখানে সাঁতার কেটেছে।
কেউ কেউ রাস্তায় চলাচলের জন্য নৌকার আশ্রয় নিয়েছেন।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ জহিরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'উপকূলীয় অঞ্চলের তুলনায় শহরে বৃষ্টিপাত বেশি। সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গা আবহাওয়াকেন্দ্রে ২১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর গতকাল এ মৌসুমের সর্বোচ্চ ২৩১.৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বর্ষা মৌসুম, পরিচলন মেঘ এবং সাগরের ওপর অতিরিক্ত বায়ুচাপের কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ভারী বর্ষণ আরও দুই থেকে তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে। বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।'
বর্ষাঋতুর শেষ মাস শ্রাবণ সমাপ্তির দিকে থাকায় বৃষ্টির পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার (১ আগস্ট) থেকে বন্দরনগরীতে বৃষ্টিপাত চলছে। তবে শুক্রবার (৪ আগস্ট) থেকে ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে।
শনিবার (৫ আগস্ট) বিকেল ৩টা থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গা আবহাওয়াকেন্দ্রে ৬৫.২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। একই সময়ে শহরের আমবাগান স্টেশনে ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। আগের ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গায় ৪২ দশমিক ৮ মিলিমিটার এবং শহরে ১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
বর্ষা মৌসুমের প্রথম দেড় মাসে চট্টগ্রামে তেমন বৃষ্টি হয়নি। গত কয়েকদিনে চলতি বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হওয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
নগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, চকবাজার, বাকলিয়া, হালিশহর, আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরগভীর পর্যন্ত পানি উঠেছে।
বৃষ্টির পানিতে রাস্তা-ঘাট ডুবে যাওয়ায় এবং শহরের অন্যান্য অংশে ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়ায় মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন।
বিঘ্নিত পরিবহনব্যবস্থা
রিকশা-অটোরিকশার চালকেরা যাত্রীদের কাছ থেকে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি ভাড়া চাচ্ছেন। এছাড়া শহরে পরিবহনসংকট তৈরি হয়েছে।
শহরের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'পানির কারণে গাড়ি বের করতে পারিনি। সিএনজি অটোরিকশা চালকেরা ১৫০ টাকার ভাড়া ৩০০ টাকা চাচ্ছেন। সব রাস্তায় পানি থাকায় অবস্থা ভয়াবহ।'
প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে চট্টগ্রামে বিমান চলাচলেও বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
'আবহাওয়া খারাপ থাকায় ঢাকা থেকে আসা তিনটি ফ্লাইট কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারেনি। এগুলোকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বিলম্বের পর বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ফ্লাইটগুলো কক্সবাজারে অবতরণ করে,' শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তসলিম আহমেদ টিবিএসকে বলেন।
এদিকে জলাবদ্ধতার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খুচরা বাজারেও।
পাইকারি বাজার থেকে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ তুলনামূলক কম বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যানচলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্য বিক্রি কমে যাচ্ছে।
অন্যদিকে বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনেও ব্যাঘাত ঘটছে।
লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল-এর পরিচালক (অপারেশন) আতাউল কবির টিবিএসকে বলেন, 'ভারী বর্ষণের কারণে গত তিনদিন ধরে বহিনোঙ্গরে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। সাধারণত বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের জন্য প্রতিদিন ৪০–৫০টি লাইটার জাহাজ বরাদ্দ থাকে। গত শনিবার থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত কোনো লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।'
খাতুনগঞ্জের আজিজ ট্রেডিং-এর মালিক আজিজুল হক টিবিএসকে বলেন, 'পানির কারণে মানুষ ঘরবন্দি। ফলে খুচরা দোকানে বিক্রিও কম। তাই আমাদের গ্রাহকেরাও এখানে আসছেন না। জরুরি প্রয়োজনে কয়েকজন ক্রেতা একসঙ্গে ট্রাকে করে অল্প পরিমাণে পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। আর শহরের বাইরে থেকেও ক্রেতা কম আসছেন।'
পাহাড়ি এলাকা থেকে সরানো হচ্ছে মানুষ
ভারী বর্ষণের কারণে ভূমিধসের আশঙ্কায় নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিচ্ছে জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার ভোররাতে ক্যাম্পাসের একটি কলোনির এক বসতঘরের দেওয়াল ধসে একজন আহত হন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান টিবিএসকে জানান, 'বিভিন্ন পাহাড় থেকে প্রায় ৮০০ পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে মহানগর এলাকায় ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।'
তিনি আরও জানান, 'উপজেলাগুলোতে ৪৯৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। এসব উপজেলায় প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রায় সাড়ে ৩০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে।'
সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আবুল হাশেম বলেন, 'আকবরশাহ, লালখান বাজার, খুলশী, পাহাড়তলী, বায়েজিদ এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।'
প্রকল্প-জলাবদ্ধতা দুটোই চলে সমানতালে
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন গত আট বছর ধরে চট্টগ্রামে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অন্তত চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু অল্প বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় শহরটি।
চলতি বছরের ২ মে বর্ষা শুরুর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, 'এবার তেমন জলাবদ্ধতা হবে না।'
কিন্তু গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ডুবে গেছে শহর।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বন্যার কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগের জন্য সিডিএকে দায়ী করছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা শুরু থেকেই বলেছিলাম, কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ করা হোক। কিন্তু তা করা হয়নি। এজন্য আজ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।'
চট্টগ্রামে মোট ৫৭টি খালের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী নদী ও হালদা নদীতে পানি নিষ্কাশন করা হয়। এর মধ্যে প্রধান ৩৬টি খালে সংস্কার, পুনরুদ্ধার, খনন, দেয়াল নির্মাণ, জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণে রেগুলেটর স্থাপনের কাজ চলছে। সিডিএ দুটি, পাউবি একটি ও চসিক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, জলাবদ্ধতা নিরসনে গত আটবছরে চট্টগ্রামে বড় চারটি প্রকল্প পেলেও সমন্বয়হীনতা, সঠিকভাবে সাম্ভাব্যতা যাচাই না করা, দীর্ঘসূত্রিতা, মাঝপথে নকশা পরিবর্তন এবং প্রকল্পকাজের ধীরগতির কারণে এসবের সুফল মিলছে না।
সেনাবাহিনী 'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' শীর্ষক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। নয় হাজার ৫২৬ কোটি টাকা বাজেটের এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। এ প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ।
চট্টগ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চার বছরে ৩০ শতাংশের কিছুটা বেশি এগিয়েছে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ধারে কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দুই হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে। সিডিএ-এর এ প্রকল্পের সময়কাল ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৭০ শতাংশের বেশি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এক হাজার ৩৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প নয় বছরেও শেষ হয়নি। ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হওয়া এ প্রকল্পটি জুন ২০২৪ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার টিবিএসকে বলেন, 'প্রকল্পকাজ শুরুর পর থেকে প্রতি বছর বলা হয়েছিল, আগামী বছর জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু প্রতি বছরই জলাবদ্ধতা হয়েছে। এজন্য জনগণ এখন তাদের বিশ্বাস করে না। আমিও বিশ্বাস করি না।'