টানা বৃষ্টি-উজানের ঢলে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা, বান্দরবান বিচ্ছিন্ন—খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট
টানা বৃষ্টি, উজান থেকে নামা ঢল এবং জোয়ারে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এ মুহূর্তে দুই জেলায় পানিবন্দি অন্তত সাড়ে ছয় লাখ মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন। বিদ্যুতের অভাবে টেলিযোগাযোগ এবং পানির কারণে সড়ক যোগাযোগ উভয়ই ব্যাহত হচ্ছে।
পার্বত্য জেলা বান্দরবান সারাদেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা শহরের কোথাও কোথাও জমেছে বুকসমান পানি। গত তিন দিন ধরে বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।
অন্যদিকে টানা ভারি বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের আট উপজেলার ৩০০ স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় লাখো গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছেন।
বন্যাকবলিত এলাকার বিভিন্ন গ্রামের বাড়িগুলোতে পানি ওঠায় বাসিন্দারা ঠিকমতো রান্নাবান্না করতে পারছেন না। এছাড়া তৈরি হয়েছে জ্বালানি ও গো-খাদ্যের অভাব। স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে বন্যাকবলিত এসব পরিবার।
এদিকে দুর্গত এলাকার পানিবন্দি পরিবারের জন্য শুকনো খাবারের পাশাপাশি রান্নাকরা খাবারের আয়োজন করেছেন চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধিরা। দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করছে বান্দরবান জেলা প্রশাসন।
বিচ্ছিন্ন বান্দরবান
কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে বান্দরবান শহর। জেলা শহরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে হাঁটুসমান পানি এবং কোথাও কোথাও বুক সমান পানি উঠেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
জেলার বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র প্লাবিত হওয়ায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ছাড়া বাকি ছয়টি উপজেলা বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে। ফলে গত রোববার (৬ আগস্ট) রাত থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
সড়কে পানি ওঠায় রোববার সকাল থেকে বান্দরবান হতে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। এছাড়া জেলা শহর থেকে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি উপজেলায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) দুপুরে বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে সার্বিক দুযোর্গ পরিস্থিতি নিয়ে এক লিখিত প্রতিবেদন জানানো হয়, বান্দরবান শহরের ৬০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় বান্দরবান সদরে ১৯২.৫ মিলিমিটার এবং লামায় ২২৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লেক্স ও খাদ্যগুদাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পাহাড়ধসে একজন রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া ভূমিধসে প্রায় ৪৫০টি ঘর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার বিভিন্ন এলাকায় আট হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলার অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মোট নয় হাজার ৫০০ জন আশ্রয় নিয়েছে।
চট্টগ্রামের ৩০০ স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক লাইন
টানা ভারি বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের আট উপজেলার প্রায় ৩০০টি স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে বিভিন্ন এলাকার প্রায় লাখো গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছেন।
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি পটিয়া-১ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আবু বক্কর সিদ্দিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভারি বর্ষণ, পাহাড়ধস এবং দমকা বাতাসে অর্ধশতাধিক বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়েছে। এছাড়া বৈদ্যুতিক সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ স্পটে।'
এ কারণে প্রায় এক লাখ মানুষ ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন রয়েছেন বলে জানান তিনি।
তবে ইতোমধ্যে সরবরাহ লাইন মেরামতে পল্লীবিদ্যুৎ কাজ শুরু করেছে জানিয়ে আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, 'আগামীকালের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।'
সুপেয় পানির সংকট
এদিকে বৃষ্টির পানি নেমে গেলেও এখনো ডুবে আছে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু এলাকাগুলো। জলাবদ্ধতার কারণে গভীর নলকূপ ও ভবনের নিচের জলাধারের পানি ব্যবহার করতে পারছেন না মানুষ।
নগরীর শমশের পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, 'জলাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ ভবনের নিচতলা এখনো পানিতে ডুবে আছে। ফলে গভীর নলকূপগুলো চালু করা যাচ্ছে না।
'আবার ভবনের নিচে থাকা রিজার্ভারে পানি প্রবেশ করায় সেগুলোও ব্যবহারের অনুপযুক্ত রয়েছে।' অনেকেই দোকান থেকে বোতলজাত খাবার পানি কিনলেও রান্না ও গোসলের পানির জন্য সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), চট্টগ্রাম-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে শাহীদ জানান, সাঙ্গু নদীর পানি দুই দিন ধরে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বান্দরবানসহ চট্টগ্রামের ভাটি উপজেলাগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে।
'সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলায় তীব্র বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভারি বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, পটিয়া, বোয়ালখালী, বাঁশখালী ও আনোয়ারার অন্তত ১৫টি ইউনিয়ন,' বলেন তিনি।
চন্দনাইশের বরমা ইউনিয়নের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, 'নলকূপ ও ল্যাট্রিন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। শিশু সন্তানদের নিয়ে দুর্ভোগে আছি।'
এদিকে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় বান্দরবান জেলায় খাদ্যপণ্য ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
বান্দরবানের গোয়ালিয়াখোলা এলাকার বাসিন্দা প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'গ্রামের সব বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে, নদীতীরের বাড়িগুলো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। নলকূপ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পান করার মতো বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছি না।'
দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি
এদিকে দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় মঙ্গলবার দুপুরে বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভাশেষে বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, 'বান্দরবানে সপ্তম দিনের মতো বৃষ্টি হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীসহ সকল বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।'
দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলায় মোট ২০৭টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'যেসব আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ রয়েছে, সেখানে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।'
এছাড়া বান্দরবান সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল রেসপন্স টিম এবং প্রত্যেক উপজেলায় কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানান, 'দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ৩৭০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আরও ১০০ টন মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে।
'নগদ আট লাখ ২৫ হাজার টাকা ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে — আরও ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া সাড়ে তিন হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট এবং প্রয়োজনীয় স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।'
চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনের জনপ্রতিনিধিরা পানিবন্দি পরিবারের জন্য শুকনো খাবারের পাশাপাশি রান্নাকরা খাবারের আয়োজন করেছেন।
চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী টিবিএসকে বলেন, 'সুপেয় পানিসংকট সমাধানে আমরা উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা নিচ্ছি। এখন শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে রান্না করা খাবারও দেওয়া হবে।'
চট্টগ্রাম-১৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'উজান থেকে নামা ঢলে চন্দনাইশ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। দুপুর থেকে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। পানীয় জলের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।'