মার্সিডিজ থেকে বিএমডব্লিউ: বিলাসবহুল গাড়ি ভাড়ার পরিষেবা যেভাবে নজর কাড়ল
বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ার ইচ্ছা থাকলেও এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তা আর্থিকভাবে প্রচণ্ড ব্যয়বহুল। তাই মানুষের এই আকাঙ্ক্ষাকে মাথায় রেখে চট্টগ্রামের এক তরুণ উদ্যোক্তা চালু করেছেন ভিন্নধর্মী এক 'রেন্ট-এ-কার' (গাড়ি ভাড়া পরিষেবা) ব্যবসা।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফিরে এসে চট্টগ্রামে বিলাসবহুল গাড়ি ভাড়া পরিষেবা ব্যবসা শুরু করেন কামাল হোসেন।
তার প্রতিষ্ঠান রয়েল অটো রেন্টালসের বহরে রেঞ্জ রোভার, ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো, এক্স-ট্রেইল, বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিজ বেঞ্জসহ রয়েছে বিলাসবহুল সব ব্র্যান্ডের গাড়ি।
করোনা মহামারির দীর্ঘ লকডাউনে বড় অঙ্কের লোকসান গুনে দেশে ফেরত আসেন আরব আমিরাত প্রবাসী কামাল হোসেন।
আবারও বিদেশে না গিয়ে হাতে থাকা মূলধনটুকু দিয়ে এবার দেশেই কিছু করার চিন্তা করেন তিনি। কিন্তু দেশে মোটামুটি ঝুঁকিহীন তেমন ব্যবসার খোঁজ পাননি। এভাবে প্রায় দুই বছর বেকার বসে ছিলেন।
সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে 'রেন্ট এ কারের' ব্যবসা শুরু করেন এই তরুণ। কিন্তু এটি তথাকথিত রেন্ট এ কার নয়; এ ব্যবসায়ে তিনি নিয়ে আসেন বিলাসবহুল গাড়ি। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় রেঞ্জ রোভার এবং বিএমডব্লিউ গাড়ি দিয়ে শুরু হয় ব্যবসা।
রয়েল অটো রেন্টালস'র এই উদ্যোক্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চট্টগ্রামে রেন্ট এ কারের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু আমি চেয়েছি ভিন্ন কিছু করতে। তাই বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে রেন্ট এ কার শুরু করেছি। কারণ চট্টগ্রামে বিলাসবহুল গাড়ির ভালো চাহিদা থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে এর কোনো উদ্যোগ ছিল না। এই সুযোগটুকু আমি কাজে লাগিয়েছি। এই সময়ের মধ্যে ভালোই সাড়া পেয়েছি।"
"বিলাসবহুল এসব গাড়ি রেন্ট এ কার হিসেবে দিয়ে কতটুকু সফল হতে পারবো, তা নিয়ে প্রথমে একটু দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু এখন টার্গেটের চেয়েও বেশি সাড়া পাচ্ছি," যোগ করেন তিনি।
ব্যবসার অবস্থা ভালো দেখে পরিচিত আরও তিন বিনিয়োগকারী গাড়ি কিনে রয়েল অটোতে দিয়েছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে পাঁচটি।
খরচ বাদ দিয়ে বর্তমানে প্রতিমাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা আয় হয় বলে জানান কামাল হোসেন। যেখানে তার মোট বিনিয়োগ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এসব গাড়ি চট্টগ্রাম নগরীতে সর্বনিম্ন ১০-২০ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যায়। তবে নগরীর বাইরে গেলে সময় বিবেচনায় একটু বেশি ভাড়া গুনতে হতে পারে।
নগরীর চট্টেশ্বরী রোডে অফিস এবং পার্কিং থাকলেও রয়েল অটোস রেন্টালসের ফেসবুক পেজেই সাড়া মিলছে বেশি।
খরচ একটু বেশি হওয়ায় প্রথমদিকে ভাড়া মিলতো কম। পরবর্তীতে ভাড়া সহনীয় পর্য়ায়ে নিয়ে আসায় এখন প্রচুর অর্ডার রয়েছে এসব গাড়ির। বর্তমানে প্রতিটি গাড়ি মাসে গড়ে ২৫টি করে ট্রিপ পায়।
কামাল জানান, বিয়ের অনুষ্ঠানে এসব গাড়ির চাহিদা রয়েছে। এছাড়া ব্যবসায়ী-শিল্প গ্রুপগুলো বিদেশি বায়ারদের পরিবহন করতে এসব গাড়ি নিয়ে যায়। এমনকি অনেকে শখের বসে পরিবার পরিজন নিয়েও বেড়াতে যায় বিলাসবহুল এসব গাড়ি নিয়ে।
জীবিকার তাগিদে ২০১৫ সালে সৌদি আরব পাড়ি দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগরীর ঘাসিয়ার পাড়া এলাকার যুবক কামাল হোসেন। সেখানে কাজ নেন ফার্নিচার কারখানায়। ছয় মাস চাকুরি করে অভিজ্ঞতা ও জমানো বেতন দিয়ে মক্কা নগরীতে গড়ে তোলেন ছোট ফার্নিচার কারখানা। প্রায় দেড় বছর ফার্নিচারের ভালো ব্যবসাও করেন।
পরে পরিচিত কয়েকজনের পরামর্শে ব্যবসা করতে ২০১৭ সালে পাড়ি জমান আরব আমিরাতে। এবার আমিরাতের উম্মুল কুইন এ গড়ে তোলেন সমির টেইলার্স নামের বোরকার কারখানা ও শোরুম।
দুজন কারিগর দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও তার টার্গেট ছিল বড় বড় শপিং মলগুলোর বাজার ধরা। সেই টার্গেটে সফলও হন তিনি। মাত্র এক বছরের মধ্যেই আবুধাবি, ফুজিরা, আলাইন সারজাসহ আরব আমিরাতের বড় বড় মলগুলোতে বোরকা সরবরাহ শুরু করেন।
দুইজন কারিগর দিয়ে গড়ে তোলা কারখানা এবং শোরুমের কর্মকর্তা-কর্মচারির সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ জনে। শুরুর কয়েক মাসের মাথায় সব ধরনের খরচ বাদে প্রতিষ্ঠানটির মাসিক লাভ দাঁড়ায় গড়ে ১৫-২০ লাখ টাকা। এভাবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভালোই চলছিল।
কিন্তু ব্যবসায় বড় ধাক্কা আসে করোনা মহামারিতে। করোনায় আরব আমিরাতে শক্ত লক ডাউনের কারণে প্রায় একবছর বন্ধ রাখতে হয় কারখানা। উৎপাদন ও বিকিকিনি বন্ধ থাকলেও দীর্ঘদিন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে প্রায় ৫০ লাখ লোকসান গুনতে হয় তাকে। পরে ২০২০ সালের শেষ দিকে লোকসানে কারখানা ও শোরুম বিক্রি করে দেশে ফিরে আসেন এই যুবক।
"পরিস্থিতি ওইরকম হওয়া সত্ত্বেও, আমি কিছু টাকা ধরে রাখতে পেরেছিলাম। ফিরে এসে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমির এক অংশ বিক্রি করে, আর আমার আয়ের টাকা দিয়ে রেন্ট এ কারের এই ব্যবসা শুরু করি," বলেন কামাল হোসেন।