চট্টগ্রাম থেকে ভারতে পণ্য পরিবহন: সেপ্টেম্বরেই চালু হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ
প্রকল্প অনুমোদনের সাত বছরের মাথায় আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত ১০.০১ কিলোমিটার রেল লাইন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে ভারতের সাথে নতুন করে আরেকটি রেল সংযোগ চালু হচ্ছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সড়ক পথের পাশাপাশি রেলপথেও চট্টগ্রাম বন্দর এবং রাজধানী থেকে পণ্য যাবে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল সেভেন সিস্টার্সে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে আখাউড়া–আগরতলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক আবু জাফর মিঞা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চট্টগ্রাম থেকে ভারতের আগরতলা পর্যন্ত রেলপথ চালুর সব কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ৯ বা ১০ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এই লাইনটি উদ্বোধন করবেন।"
তিনি আরও জানান, সম্ভাব্য উদ্বোধনের দিনকে সামনে রেখে এই রেলপথের ফিনিশিংয়ের কাজ এখন চলছে পুরোদমে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেনারবাহী ট্রেন আগরতলা হয়ে ভারতের সেভেন সিস্টারে যাবে। এরপর যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলও শুরু হবে।
"গত সপ্তাহে দুদেশের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছে। এছাড়া ভারতের ব্যবসায়ীরা যাতে রেলপথ ব্যবহার করে পণ্য নিয়ে যেতে পারে সেজন্য আমরা চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমস ও বিজিবির সঙ্গে বৈঠক করেছি", যোগ করেন তিনি।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় এই রেললাইনটি নির্মাণে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ৪৭৮ কোটি টাকার প্রকল্পে ৪২১ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে দিচ্ছে ভারত সরকার। ঠিকাদার নিয়োগে বিলম্ব, কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে সময়মত কাজ না হওয়ায় প্রকল্পটির মেয়াদ পাঁচ দফায় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
প্রকল্পের সুবিধা
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারসহ পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে রেল পরিবহনে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
এর ফলে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার এবং রপ্তানি নির্ভর ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার ঘটবে বলেও ধারণা দেওয়া হয়েছিল।
তাছাড়া আখাউড়া হয়ে ভারতের কলকাতা ও আগরতলার মধ্যে নতুন রেল যোগাযোগ স্থাপনে ভূমিকা রাখবে প্রকল্পটি।
এই রেল সংযোগটি ইতোমধ্যে ঘোষণা করা ১৬টি ট্রানজিট রুটের অংশ। এটি চালু হলে আগরতলা এবং কলকাতার দুরত্ব প্রায় ১,১০০ কিলোমিটার কমবে। পাশাপাশি ভ্রমণের সময় ৩১ ঘন্টা থেকে কমে ১০ ঘন্টা হবে; যা দেশটির বাণিজ্য, পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ উন্মুক্ত করবে।
সংশ্লিষ্টরা বরছেন, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ চালুর ফলে সড়ক পথের পর রেলপথেও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারতের ব্যবসায়ীরা।
এটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বাণিজ্য বাড়াতে সাহায্য করবে এবং পণ্যের দ্রুত এবং সাশ্রয়ী পরিবহন সহজতর করবে। তবে এখন পর্যন্ত ভারত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কোন ধরনের পণ্য আসবে বা তা ট্রেনে পরিবহন করে আখাউড়া নিয়ে যাওয়া হবে কি না, সেটি এখনও নির্দিষ্ট করা হয়নি।
পণ্য পরিবহন
প্রকল্পের পরিচালক আবু জাফর মিঞা বলেন, "ইতোমধ্যে আমরা ইমিগ্রেসন স্টেশনসহ প্রয়োজনীয় সকল স্থাপনা তৈরি করেছি। সার্বিক দেখভালের জন্য লোক নিয়োগের কাজ চলছে। উদ্বোধনের পর প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরসহ ঢাকা কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) থেকে সরাসারি পণ্য নিয়ে (কন্টেনারবাহী ট্রেন) আগরতলা হয়ে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল সেভেন সিস্টার্সে যাবে।"
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ট্রানজিট পণ্য এলে তা এখন থেকে রেলপথেও পরিবহন করা হবে; চট্টগ্রাম বন্দরের সে প্রস্তুতি রয়েছে। কাস্টমসও সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা ট্রানজিট পণ্য নিয়ে ভারতের কোনো জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে কিনা সেটি নিশ্চিত নই।"
সরেজমিন আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথ প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাংলাদেশ অংশের সম্পূর্ণ রেলপথে রেললাইন বসানো প্রায় শেষ। শুধুমাত্র খারকোট এলাকায় রেলক্রসিংয়ের অংশে ৫০ মিটার রেললাইন বসানো বাকি।
এছাড়া, প্রকল্পের ১৬টি সেতু ও কালভার্টের সবকটির কাজই শেষ হয়েছে ইতোমধ্যেই। আর ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ভবনের নির্মাণ ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে।
উদ্বোধন সামনে রেখে খারকোট রেলক্রসিং অংশে রেললাইন বসানোর কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।
রেল সংযোগের বিস্তারিত
স্বাধীনতার আগে আখাউড়া-আগরতলার রেলপথ চালু ছিল। ভারতীয় ঋণ সহায়তায় বাস্তবায়িত এই প্রকল্পে রেললাইনের দৈর্ঘ্য ১৫.০৬৪ কিলোমিটার। এরমধ্যে ভারতে ৫.০৫ কিমি এবং বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১০.০১ কিমি।
আগরতলার উপকণ্ঠে নিশ্চিন্তপুরে একটি আন্তর্জাতিক অভিবাসন স্টেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আখাউড়াকে সংযুক্ত করা হবে।
এই স্টেশনটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য বিনিময়ের জন্য একটি ডুয়েল গেজ স্টেশন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আজিজুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথটি চালু হলে দুই দেশের বাণিজ্য বাড়বে। আমদানি খরচ কমে আসলে ভোক্তা পর্যায়ে কম মূল্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়া যাবে। ফলে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এই রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় জানানো হয়, এ পর্যন্ত বরাদ্দের ৭১ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ শতাংশ।