আরও ফ্রেইট ট্র্যাক, আইসিডি হলে কি রেলের ভবিষ্যৎ বদলাবে?
পণ্য পরিবহনে নিজেদের হিস্যা বাড়াতে এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়ার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সমুদ্র ও স্থল বন্দরগুলোর সঙ্গে ডেডিকেটেড ফ্রেইট ট্র্যাক এবং কানেক্টিভিটি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের প্রস্তুত করা একটি কৌশলগত পরিকল্পনায়।
ভবিষ্যত কৌশলগত পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে আছে ব্রডগেজ লাইনে পূর্ণ রূপান্তর, আরও ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) নির্মাণ এবং রেল সেবার আধুনিকীকরণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ক্রয়। আগামী ১০ বছরে সম্পূর্ণ পরিচালন খরচ উঠিয়ে আনা নিশ্চিত করাও এ পরিকল্পনার লক্ষ্য।
বাণিজ্যিক সেবার মাধ্যমে রেলওয়ের আয় বাড়ানোর জন্য বেসরকারি খাতের অপারেটরগুলোর মাধ্যমে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও টেলিকম কোম্পানিগুলোর কাছে রেলওয়ের অপটিক্যাল ফাইবারগুলোর অতিরিক্ত ক্ষমতা ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
ভ্রমণের সময়কে তিন ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনটির প্রথম ব্রডগেজ ডাবল ট্র্যাক হওয়ার কথা রয়েছে, যা কনটেইনার ট্রেনের জন্য ডেডিকেটেড হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রস্তুত করা ইন্টিগ্রেটেড নেটওয়ার্ক প্ল্যানিং অ্যান্ড সেক্টর প্ল্যান প্রিপারেশন এক্সারসাইজ অনুযায়ী, আগামী ১০-১৫ বছরে ঢাকা থেকে মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরেও ডেডিকেটেড ফ্রেইট ট্রেন চালু করা যেতে পারে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামোতে (এমটিবিএফ) ২০২৭-২৮ অর্থবছর পর্যন্ত রেলওয়ের প্রকল্পের জন্য মোট ১০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। নতুন কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কী পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশন আগামী ১১ সেপ্টেম্বর রেলওয়ে কর্মকর্তা ও স্টেকহোল্ডারদের সামনে কৌশলগত পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করবে।
ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ডক্টর মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, ট্রেনে কনটেইনার পরিবহন অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী। এই পরিবর্তন শুধু সড়ক অবকাঠামোর উপর চাপই কমাবে না, সেইসঙ্গে রেলকে লাভজনক করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এমদাদ উল্লাহ আরও বলেন, 'পরিকল্পনা কমিশন থেকে এ বিষয়ে একটা প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যমাত্রা চাওয়া হবে।'
একটি মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, আমদানি-রপ্তানি পণ্য দ্রুত পরিবহনের লক্ষ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে একটি ডেডিকেটেড ফ্রেইট ট্র্যাক নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ)।
নৌপরিবহন সচিব মোস্তফা কামাল গতকাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এ ধরনের কোনো প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি অবগত নন। তিনি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে—তারপর সড়কপথে আরও বেশি পরিমাণে পণ্য পরিবহন করা যাবে। তারপরও ডেডিকেটেড রেল লাইনের প্রয়োজন হবে কি না, তা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিপিএ চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহেল ও বন্দর সচিব ওমর ফারুক দেশের বাইরে থাকায় মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা যায়নি; বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিমকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, রেলওয়ে তাদের বিদ্যমান মাস্টার প্ল্যানের (২০১৫-২০৪৫) লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়েছে। কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে করিডরভিত্তিক প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানান তারা।
পণ্য পরিবহন বাড়ানোর আশা রেলওয়ের
১৯৬৯-৭০ সালে ৪.৮ মিলিয়ন টন পণ্য পরিবহন করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। পরে সড়ক পরিবহনের কাছে ফ্রেইট ব্যবসা হারানোর কারণে এটি এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধি, রোলিং স্টক (লোকোমোটিভ, ওয়াগন ইত্যাদি) বাড়ানো এবং চলমান রূপান্তর ও লাইন সম্প্রসারণ প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে ২০৪৫ সালের মধ্যে রেলওয়ের পণ্য পরিবহন বেড়ে ১৮ মিলিয়ন টন হবে বলে আশা করা হয়েছে রেলওয়ের মাস্টার প্ল্যানে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে বছরে মাত্র ২ মিলিয়ন টন পণ্য পরিবহন করে।
দেশে মাত্র দুটি আইসিডি রয়েছে—একটি কমলাপুরে, অপরটি পানগাঁওয়ে।
মাস্টার প্ল্যানে গাজীপুরের ধীরাশ্রমে একটি নতুন আইসিডি এবং বেনাপোল স্থলবন্দর ও উত্তরা ইপিজেডে আরও দুটি আইসিডি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ মিলিয়ন টিইইউ (টুয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট) কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে। এর মধ্যে মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মাত্র ১.৫৬ শতাংশ করেছে কমলাপুর আইসিডি।
প্রতিদিন তিন থেকে চারটি ফ্রেইট ট্রেন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার কমলাপুর আইসিডি পর্যন্ত কনটেইনার নিয়ে চলাচল করে। প্রতিটি ট্রিপে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে।
রেলওয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, রেলের মোট আয়ে সারা দেশের ফ্রেইট ট্রেনগুলোর অবদান এখন মাত্র ২১ শতাংশ; আর রেলের গড় গতি ঘণ্টায় ১২ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। তবে পাথর, লোহা, ইস্পাত ও খাদ্যশস্য পরিবহনে রেলওয়ের আধিপত্য রয়েছে। আর চট্টগ্রাম বন্দরের ঢাকাগামী কনটেইনারগুলোর প্রায় ১০ শতাংশ হ্যান্ডেল করে রেলওয়ে।
মাস্টার প্ল্যানে বলা হয়েছে, পরিবেশবান্ধব হওয়ায় রেলওয়ে রাস্তায় ট্রাকের সংখ্যা কমিয়ে সরকারের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যকে সহায়তা করবে।
শুধু ব্রডগেজ ট্র্যাক
আখাউড়া-লাকসাম অংশের লুপ লাইন, ব্রডগেজ ডাবল ট্র্যাকের সমাপ্তি এবং ঢাকা-কুমিল্লা কর্ড লাইন ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে ভ্রমণের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এসব কাজ সম্পন্ন হলে যাত্রীবাহী ট্রেনের ভ্রমণের সময় ছয় ঘণ্টা থেকে কমে মাত্র তিন ঘণ্টায় নেমে আসবে।
রেলওয়ের মাস্টার প্ল্যান অনুসারে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের রূপান্তরটি প্রথমে ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বৈদেশিক ঋণ পেতে অসুবিধা হওয়ায় প্রকল্পটি শুরু করা যায়নি।
এই আপগ্রেডেশন প্রচেষ্টা রেলের পরিবহন সক্ষমতাও বাড়াবে, যার ফলে ট্রেনগুলো ৩০ শতাংশ বেশি যাত্রী এবং পণ্য বহন করতে পারবে বলে জানান রেলওয়ে কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। এছাড়া লাকসাম-চট্টগ্রাম ও টঙ্গী-আখাউড়া উভয় রেললাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তরিত করা হয়েছে, যা চট্টগ্রাম ও ঢাকাকে ব্রডগেজ রেললাইনের সাথে সংযুক্ত করেছে।
এছাড়াও কক্সবাজার পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল সংযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কাজ চলছে। উল্লেখ্য, এডিবির অর্থায়নে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
করিডর উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের প্রস্তাব
রেলওয়ে কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডরের উন্নয়নে ঋণ প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করে করিডরভিত্তিক উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েকটি বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
পরবর্তীতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ বছরের জুলাইয়ে বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটির কাছে একটি ঋণ প্রস্তাব জমা দেয়। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা; এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১০ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রেল করিডর উন্নয়নে পাঁচটি মূল উপাদান রয়েছে; এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডর সম্প্রসারিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড মিটারগেজ সেকশনকে ডুয়েলগেজ ডাবল-ট্র্যাকে রূপান্তর করার পাশাপাশি বে টার্মিনাল ও রেলওয়ে নেটওয়ার্কের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা।
এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে কমলাপুর রেলস্টেশনকে মাল্টি-মডাল পরিবহন হাবে পরিণত করা হবে। বিদ্যমান কমলাপুর আইসিডির ৪০.৬ একর জায়গাজুড়ে এ হাব তৈরি হবে। এছাড়া পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে কমলাপুর ডিপোকে ধীরাশ্রম স্টেশনে স্থানান্তর করা, উন্নত কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও স্ট্যাকিং সুবিধা দেওয়া।
মাল্টিমডাল হাবটি মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাই-স্পিড ট্রেন ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে সহায়তা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তাছাড়া কমলাপুর ছাড়াও ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনকেও মাল্টি-মডাল পরিবহন হাবে রূপান্তরিত করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের একটি মিশন গত বছরের ১১ থেকে ২২ এপ্রিল এবং ৩ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর দুই দফায় বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিদর্শন করে। পরিদর্শনকালে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা প্রকল্পের স্থান পরিদর্শন করেন এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন।