প্রতিযোগিতামূলক দামে খাদ্যপণ্য রপ্তানির প্রস্তাব রাশিয়ার
রাশিয়া সরকার-টু-সরকার (জিটুজি) ভিত্তিতে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক দামে বাংলাদেশে কিছু খাদ্যপণ্য রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের আসন্ন ঢাকা সফরের সময় বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামরিক সহযোগিতার পাশাপাশি রাশিয়া থেকে খাদ্যপণ্য আমদানিসহ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক বিষয়ও গুরুত্ব পাবে বলে জানা গেছে।
রাশিয়া সম্প্রতি গত ১৭ জুলাই মেয়াদ শেষ হওয়া কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় প্রস্তাবটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ থেকেই গম, সূর্যমুখী তেল ও সার আমদানি করত বাংলাদেশ। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে এসব আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জেএসসি এফইসি প্রোদিনতর্গ-এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে রাশিয়া। বিশেষ করে জিটুজি ভিত্তিতে হলুদ মটর, ছোলা, লাল মসুর, সবুজ মসুর ডাল, সূর্যমুখী তেলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, তারা সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মূল্যে এসব খাদ্যপণ্য সরবরাহ করার সুযোগ নিতে চায়।
লাভরভের সফরকালে সামরিক সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকাল থেকে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৭ সেপ্টেম্বর জাকার্তা থেকে ঢাকায় আসবেন।
৭ সেপ্টেম্বর দেশে পৌঁছেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি লাভরভ। পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে জি২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারত যাবেন তিনি।
রাশান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বিষয়টি জানিয়ে গত ২৬ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক নোট ভারবাল পাঠায় ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস।
রাশিয়ার রাষ্ট্র-মালিকানাধীন জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ফরেন ইকোনমিক কর্পোরেশন 'প্রোদিনতর্গ' এসব খাদ্যপণ্য রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে। এটি রাশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি।
এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষকে লেখা এক চিঠিতে রুশ কোম্পানিটি লিখেছে, ২০১৩ সাল থেকে তারা বাংলাদেশে জিটুজি ভিত্তিতে রাসায়নিক সার ও খাদ্যশস্য রপ্তানি করে আসছে। কোম্পানিটি বাংলাদেশে ১.৩ লাখ টনেরও বেশি পটাশ সার এবং ১.৫ লাখ টনের বেশি গম রপ্তানি করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ট্রেডিং করপোরেশন অভ বাংলাদেশ (টিসিবি) দেশের এক কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করছে, যেখানে মসুর ডালও দেওয়া হয়।
ফলে টিসিবিকে মসুর ডাল আমদানি করতে হয়। এছাড়া বাংলাদেশে সূর্যমুখী তেলেরও চাহিদা রয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দামে এসব পণ্য পাওয়া গেলে রাশিয়া থেকে আমদানি করা যেতে পারে বলে জানান কর্মকর্তারা।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যেসব পণ্য আমদানি করি, সেসব পণ্য কম দামে রাশিয়া থেকে আমদানির সুযোগ থাকলে তা নেওয়া যেতে পারে।'
তবে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সুইফট নিষেধাজ্ঞার কারণে পেমেন্ট সিস্টেম কী হবে, তা নিয়েও আলোচনা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তৌহিদ হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এই প্রথম রাশিয়ার উচ্চপর্যায়ের এই সফরের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। তবে তা নির্ধারিত হবে সফরের আলোচনার ফলাফল কতটা হবে, তার ওপর।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পশ্চিমা চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়া মস্কো বাংলাদেশের সমর্থন চেয়ে একের পর এক চিঠি পাঠিয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রাশিয়া আগে কখনও মুখ না খুললেও বছরখানেক ধরে তাদের অবস্থান পাল্টেছে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনীতিবিদদের ভূমিকাকে নব্য উপনিবেশবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এ ধরনের পদক্ষেপ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে 'নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ'।
দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ঢাকা-মস্কো সম্পর্ক জোরদার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের প্রসঙ্গগুলো আসবে বলে জানা গেছে।
এর পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সইয়ের অপেক্ষায় থাকা প্রায় ২০টির মতো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিষয় নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
প্রস্তাবিত সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষা, বন্দি প্রত্যর্পণ, মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মতো বিষয় রয়েছে বলে জানা গেছে।
বাণিজ্য সম্ভাবনা
গত বছরের শুরুর দিকে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন-এর (ইএইইউ) সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন এই অর্থনৈতিক ইউনিয়নের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে বেলারুশ, কাজাখস্তান, আর্মেনিয়া ও কিরগিজস্তান। এই এফটিএর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন খাতের রপ্তানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো।
পূর্ব ইউরোপের এই পাঁচটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বছরে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, এফটিএ চুক্তি করলে এই বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে।
২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ও ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন মস্কোতে সহযোগিতা স্মারক (এমওসি) স্বাক্ষরের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। পরে ১৯টি খাতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়।
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ বর্তমানে ইউরেশিয়ান বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। এ বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের (আরএমজি) রপ্তানি ছিল মোট ৪২৬ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। রপ্তানিকারকরা মনে করেন, চলমান যুদ্ধ না থাকলে রাশিয়া একাই বাংলাদেশ থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করতে পারত।
২০২২ সালের ১৪ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া একটি প্রতিবেদনে সরকারকে গম, সার ও ভোজ্য তেলের মতো প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য আমদানির বিনিময়ে রাশিয়ায় ওষুধ ও আলু রপ্তানির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেছিল মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাস। এ বাণিজ্য জিটুজি ভিত্তিতে অথবা মুদ্রা বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) মাধ্যমে সহজে করা যেতে পারে। এভাবে বাণিজ্য করলে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফটে রাশিয়ার অংশগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না।