স্যালাইন সংকটে বেসরকারি হাসপাতাল ও ফার্মেসি
তীব্র জ্বর নিয়ে সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন মালিবাগের বাসিন্দা আয়েশা বেগম (৬০)। হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকরা তাকে কিছু ওষুধের পাশাপাশি স্যালাইন দিতে বলেন। তবে স্যালাইন কিনতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যান রোগীর স্বজনেরা।
হাসপাতালের ফার্মেসি, মগবাজার ও ইস্কাটনের বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে খোঁজ করেও ইনজেক্টেবল স্যালাইন পাননি তারা। পরে শাহবাগের কয়েকটি দোকান ঘুরে চার ব্যাগ স্যালাইন নিয়ে আসেন আয়েশা বেগমের ছেলে।
শুধু আয়েশা বেগম নন, স্যালাইন সংকটের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন রোগীকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো তীব্র স্যালাইন সংকটে ভুগছে। তবে সম্প্রতি দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্যালাইন সংকট কাটলেও বেসরকারি হাসপাতালে সংকট এখনও কাটেনি।
এদিকে, সরবরাহ সংকটের কারণে স্যালাইনের দামও বেড়ে গেছে দুই থেকে তিন গুণ।
সংকট মেটাতে বাজার মনিটরিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে স্যালাইন আমদানি করা হলে এ সপ্তাহে সংকট কেটে যাবে বলে জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ লেলিন চৌধুরী বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন চাহিদার তুলনায় স্যালাইনের সংকট অনেক বেশি। আমরা কোম্পানিকে ১০০ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা দিলে ১০ বা ২০ ব্যাগ স্যালাইন পাই। আগে আমরা একজন লোক পাঠিয়ে মিডফোর্ড মার্কেট থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী স্যালাইন নিতে পারতাম। এখন স্যালাইনের খোঁজে তিন চারজনকে মিডফোর্ড মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে পাঠাতে হচ্ছে। স্যালাইনের সর্বোচ্চ দাম ৯০-৯৫ টাকা ছিল, এখন সেই স্যালাইন আমরা ২০০ টাকা প্যাকেট কিনছি।"
"আমাদের ফার্মেসিতে স্যালাইন না থাকায় রোগীদের আমরা লিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছি, তারা বিভিন্ন দোকান খুঁজে খুঁজে স্যালাইন কিনছে। সংকটের কারণে দাম বাড়ায় একদিকে রোগীদের চিকিৎসা খরচ যেমন বেড়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি ভোগান্তিও বাড়ছে অনেক," যোগ করেন তিনি।
ইস্কাটনের মেডিকেয়ার ফার্মেসির দোকানদার আবদুল ফয়সাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্যালাইনের সংকট এখন অনেক বেশি। প্রতি সপ্তাহে দুইদিন ২০ ব্যাগ করে স্যালাইন পাই আমরা, কিন্তু এর তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। শুধু ডেঙ্গু রোগী না, অন্যান্য রোগে আক্রান্তরাও স্যালাইন না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে প্রতিদিন।"
এছাড়া, গতকাল দেশের অন্যতম বড় ওষুধের দোকান লাজফার্মায় ফোন করেও কোনো ইনজেক্টেবল স্যালাইন পাওয়া যায়নি।
চিকিৎসকরা জানান, সাধারণ স্যালাইন শুধু ডেঙ্গুই না সিজার, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের সংকটে অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. রাজীব দে সরকার টিবিএসকে বলেন, "নরমাল স্যালাইনে ০.৯% সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে। অপারেশনের পর রোগীর ফ্লুইড ম্যানেজ করার জন্য স্যালাইনের প্রয়োজন হয়, ডেঙ্গুর চিকিৎসাও ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট। স্যালাইন সংকটের কারণে সার্জারির রোগীদের সমস্যা হচ্ছে। প্রাইভেট হাসপাতালে মূলত এই সংকট বেশি।"
সিন্ডিকেট ভাঙতে বাজার মনিটরিংয়ের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
স্যালাইনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং এর দাম বাড়াতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে বাজার মনিটরিংয়ের আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ ও ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তারা।
ডা. রাজীব দে সরকার বলেন, ''একটি বেসরকারি হাসপাতালে আমার পরিচিত একজনের ছোট একটি সার্জারি পিছিয়ে গেছে স্যালাইনের সংকটে। যে স্যালাইনের দাম সর্বোচ্চ ৮০-৯০ টাকা। আমার রোগী ৫০০ টাকায় কিনেছে সেই স্যালাইন। ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা মূলত সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। ডিম, মরিচ বা ডাবের দাম যেমন সিন্ডিকেট করে বাড়ে, তেমনি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে স্যালাইনের দামও বাড়ানো হচ্ছে।"
ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেডের সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল বাশার টিবিএসকে বলেন, "গত আগস্টে আমরা ৩০দিন তিন শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করেছি। এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানির মাধ্যমে আমরা সরকারি হাসপাতালে ৩ লাখ ব্যাগের বেশি স্যালাইন দিয়েছি। কিন্তু এত ডেঙ্গু রোগী তো হাসপাতালে নেই। তাহলে এত স্যালাইন যাচ্ছে কোথায়?"
"এছাড়া, ২৫০-৩০০ ফার্মেসিকে আমরা নিয়মিত স্যালাইন দিচ্ছি, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেও স্যালাইন দিচ্ছি। সুতরাং, বাজার মিনিটর করা জরুরি। মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বলে আমাদের ধারণা," বলেন তিনি।
এদিকে স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় চট্টগ্রাম মেডিকেলের পূর্ব গেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপ-পরিচালক নুরুল আলম টিবিএসকে বলেন, "দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো তিন শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করছে, পাশাপাশি স্যালাইন আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দুই একদিনের মধ্যে আমদানির স্যালাইন চলে আসলে স্যালাইনের সংকট কেটে যাবে।"