চট্টগ্রামে ড্রেনে পড়ে মৃত্যু: আত্মতুষ্টি থেকে উদ্ভূত এক ট্র্যাজেডি
১০ সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রামে খোলা ড্রেনে পড়ে মারা যাওয়া ছেলে আব্দুলের লাশ শনাক্ত করার আট দিন পর কাজে ফিরেছেন ভ্যান চালক মোঃ কামাল। পুত্র শোকে কাতর এই বাবার অবশ্য দীর্ঘ দিন কাজ থেকে বিরত থাকার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। মোঃ কামাল বলেন, আমার নিয়োগকর্তা (প্রাণ কোম্পানি) আমাকে শোক কাটিয়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন এবং আমি কাজে ফেরার মতো অবস্থা হলে যোগ দিতে বলেছেন। কিন্তু আমাকে অনেক বিল পরিশোধ করতে হবে।
১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাসা থেকে ফোন করে আব্দুলের নিখোঁজ হওয়ার খবর দেওয়া হয় কামালকে। তিনি তখন মার্কেটে। কামাল বলেন, আমরা তৎক্ষণাৎ মাইকিং করে তার খোঁজ করা শুরু করি। পরেরদিন ফজরের নামাজের সময়, ভোর ৪টা পর্যন্ত খোঁজ করা হয়।
সকাল ৮টা থেকে আবারো খোঁজ করা শুরু করেন কামাল। এবার দুটি ভ্যান দিয়ে আশেপাশের এলাকায় মাইকিং করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কামাল শুনতে পান, একটি শিশুর ভাসমান লাশ দেখা গেছে। কামাল বলেন, আমরা ছুটে আসি। ছোটপোল পাঁচতলার [এলাকা] একটি ড্রেন থেকে আমার ছেলের লাশ উদ্ধার করা হয়। একটি সিএনজিতে করে আমি ছেলের লাশ বাসায় নিয়ে আসি। আশেপাশের মানুষজন সিএনজিতে লাশ তুলতে আমায় সাহায্য করেন।
কামাল বাসায় যাওয়ার ১৫ মিনিট পর সেখানে পুলিশ আসে।
কামাল জানান, সম্প্রতি আব্দুলকে বাসা থেকে ৫০-৬০ ফুট দূরের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল ছেলেকে হাফেজ বানাবেন। আব্দুল মাঝে মাঝে বাড়ির কাছে একটি গ্যারেজে খেলতে যেত ।
আব্দুল খুব শান্ত স্বভাবের ছিল বলে জানান কামাল। তিনি বলেন, আমাদের কলোনিতে (হালিশহর থানায়) প্রায় ৩০০ পরিবারের বসবাস। আব্দুলের সমবয়সী অনেক ছেলে-মেয়ে আছে এখানে। আমি তাকে কখনো মারামারি করতে দেখিনি। আমার ছেলে খুব সহজ সরল ছিল।
কামালের ঘর থেকে প্রায় ২০ হাত দূরে একটি খোলা ড্রেন। ধারণা করা হচ্ছে, আব্দুল সেখানে পিছলে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়।
আগামী ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ আব্দুলের বয়স ছয় বছর হওয়ার কথা। তার দেড় বছরের আরো একটি ছোট ভাই আছে। ছেলের দাফনের জন্য অফিস থেকে কামালকে দেওয়া হয় ৬,০০০ টাকা। আরো ৪,৫০০ টাকা তিনি ধার নেন শাশুড়ির কাছ থেকে। তিনি বলেন, আমরা দিন আনি দিন খাই। আমাদের কোনো সঞ্চয় নেই ।
কামাল বলেন, এর আগেও ড্রেনে পড়ে মানুষের মৃত্যুর কথা শুনেছি। গত বছরও একজনের মৃত্যুর কথা শুনেছি। এটি (ড্রেন) রাস্তা থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি উঁচু। মানুষ ছাড়াও এখানে সিএনজি, অটোরিক্সা দুর্ঘটনার কবলে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি আছে।
ডবলমুরিং থানার সাব-ইন্সপেক্টর প্রতুল বড়ুয়া বলেন, 'গত আগস্টের শেষদিকে ইয়াসিন আরাফাত নামে আরেক কিশোরের মৃত্যু হয় এভাবে। উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়া কেএম হাশেম টাওয়ার এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। সে লাশ হালিশহর থানায় হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তী আর কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই।'
যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে হালিশহর থানার ওসি প্রথমে কল রিসিভ করেননি। পরে সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) তিনি কল কেটে দেন। এর আগে চলতি সপ্তাহের শুরুতে যোগাযোগ করা হলে অন্য থানায় এ বিষয়ে কথা বলতে বলেন তিনি।
আগস্টের শুরতে ভারি বর্ষণের ফলে জলাবদ্ধ বন্দর নগরীতে নীপা পালিত নামে এক কলেজ ছাত্রী ড্রেনে ডুবে মারা যায়।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডক্টর মুহম্মদ রশিদুল হাসান বলেন, 'নর্দমাগুলো খোলা রাখার কারণ রয়েছে (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে)। চট্টগ্রাম দেশের অন্যান্য জায়গার মতো নয়, পাহাড়ে ঘেরা। বৃষ্টি হলেই মাটি ধসে পড়ে। তখন মাটি এই ড্রেন ও খালগুলোকে ভরাট করে দেয়। ড্রেনগুলি দেয়াল বা স্ল্যাব দিয়ে বন্ধ করে দিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিষ্কার করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা একমত। যাইহোক, বিকল্পও আছে।
'একটি গ্রিল বা অন্য কিছু এই খোলা ড্রেনের উপর বসানো যেতে পারে, যাতে মানুষ এবং যানবাহন এটি শনাক্ত করতে পারে এবং নিরাপদ থাকে।' যোগ করেন তিনি।
চুয়েটের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণা অনুযায়ী, গত চার থেকে পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে খোলা নালা ও ড্রেনে অন্তত সাতজনের মৃত্যুর হয়েছে।
অধ্যাপক হাসান টিবিএসকে বলেন, আব্দুলসহ সংখ্যাটা আট হবে।
বন্দর নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে ছয়টি সংস্থা- সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা, ডব্লিউডিবি, বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যুক্ত রয়েছে।
চট্টগ্রামের জন্য ২০ বছরের (১৯৯৫-২০১৫) মহাপরিকল্পনা গৃহিত হয় ১৯৯৯ সালে। সেখানে তিন ধরনে ড্রেনের- টারশিয়ারি, সেকেন্ডারি এবং প্রাইমারি- কথা বলা হয়েছে।
টারশিয়ারি হল আমাদের বাসার চারপাশে দেখতে পাওয়া ড্রেনগুলি। আর প্রাইমারিগুলি হল খাল, যা নদীগুলির সাথে সংযুক্ত।
অধ্যাপক হাসান বলেন, টারশিয়ারি এবং সেকেন্ডারিগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না।
তার মতে, চট্টগ্রামে খাল নির্মাণ বা উন্নয়নে ১১ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পে ৩৬টি খাল নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যদি পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িতও হয়, তারপরও ২১টি খাল নির্মাণাধীন থেকে যাবে।
বর্তমানে সিডিএর অধীনে থাকা প্রকল্পটি সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। তবে এখনো হস্তান্তর করা হয়নি।
খোলা ড্রেনে পড়ে মৃত্যু একটি গুরুতর ঘটনা কিন্তু এটি কেবল বৃহত্তর সংকটের একটি ছোট অংশ মাত্র। আর সে সংকট হলো, চট্টগ্রামের নগর পরিকল্পনার ভুল ব্যবস্থাপনা।
টিবিএসের আগের এক প্রতিবেদনে, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, সিডিএ'র প্রকল্পের অধীনে খাল থেকে ৯.৫ মিলিয়ন ঘনমিটার মাটি পরিষ্কারের কথা ছিল । কিন্তু তারা এক-চতুর্থাংশ মাটিও সরায়নি। সড়ক তৈরির জন্য খালের প্রস্থ কমানো হয়েছে, কিন্তু এখন খালের গভীরতাও কমেছে। ফলে পানির প্রবাহ কমেছে।
মেয়র বলেন, 'এছাড়া পানির ক্লোসেটগুলো কার্যকর নয়। পাম্প দিয়ে পানি সরানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে এখনো জলাবদ্ধতা রয়ে গেছে।
টিবিএসের একই প্রতিবেদনে, সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস উক্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রকল্পগুলির অধীনে খালগুলি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল। তবে, সিটি কর্পোরেশন ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করেনি। সে কারণেই খাল থেকে খালে নির্বিঘ্নে পানি প্রবাহিত হতে পারে না। ফলে জলাবদ্ধতা থেকে যায়।
সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এভাবেই চট্টগ্রামের নগর উন্নয়নের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগুলো থমকে যাচ্ছে।
খোলা ড্রেনে আব্দুলের মৃত্যুর বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি চট্টগ্রাম খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোঃ শাহ আলীর কাছে পাঠান।
মোঃ শাহ আলী টিবিএসকে বলেন, আপনি যে খোলা ড্রেনের কথা বলছেন তা আমার এখতিয়ারের অধীনে নয়। আমরা কয়েকশ কিলোমিটার ড্রেন তৈরি করছি। সবগুলোই স্ল্যাব দিয়ে আচ্ছাদিত। খোলা ড্রেন নিয়ে আমি মন্তব্য করতে পারি না।
বন্যা না হলেও এই খোলা ড্রেনগুলি একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধ্যাপক হাসান বলেন,
আমি সম্প্রতি এই খোলা ড্রেনের একটিতে একজন নারী এবং একটি শিশুকে বহনকারী একটি সিএনজি পড়ে যাওয়ার কথা শুনেছি। এটি সত্যিই উদ্বেগের কারণ।
পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন্যার কারণে এরকম মৃত্যুর শঙ্কা বেড়ে যায়, যেমনটা নীপা পালিতের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহম টিবিএসকে এর আগের এক প্রতিবেদনে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমরা এত উঁচু জোয়ার দেখিনি। এটি নিয়মিত উচ্চতা থেকে ০.৫ মিটার বেশি। এর ফলে শহরে পানি ঢুকে পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনকে অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আগস্টে যেখানে গড় বৃষ্টিপাত হয় প্রায় ৫৩০ মিলিমিটার। সেখানে আগস্টের প্রথম সাত দিনে বৃষ্টিপাত হয় ৫৮৭ মিলিমিটার।