ঢাকাবাসীর এক অসহনীয় রাত, ১৪ ঘণ্টা পরও অনেক এলাকায় জমে আছে পানি
"আমি ট্রান্সপোর্টের জন্য আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করি অফিসের সামনে। শেষমেশ রাত ২টায় যেয়ে বাসায় পৌঁছাই," বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত ইয়াসমিন সুলতানা এভাবেই গত রাতের (২১ সেপ্টেম্বর) অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে।
তিনি বলেন, "বাড্ডা এলাকায় কোমর পর্যন্ত গভীর পানি ছিল। রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর একটি সিএনজি পাই আমি।"
গত রাতে ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকা শহরে ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে পুরো শহরের বেশিরভাগ রাস্তা। রাতে যাতায়াত করা শহরবাসীকে এক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে নিজ গন্তব্যে যেতে হয়েছে।
অনেকেই রাতে কোনো পরিবহন না পেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাছাড়া, যেসব পরিবহন ছিল সেগুলোও তিন থেকে চারগুণ ভাড়া দাবি করছিল।
বেসরকারি চাকরিজীবী শারমিন আক্তার বলেন, "কাল রাত ৯টায় আমি অফিস থেকে বের হই, অফিসের নিচের রাস্তায় তখন পানি জমে গেছে, হাঁটার উপায় নেই। অফিস থেকে বের হয়ে একটি রিকশা পাই, তখন বৃষ্টি কিছুটা কম। তবে রিকশা মগবাজার সিগন্যালে যাওয়ার পর শুরু হয় তীব্র বৃষ্টি। আধাঘণ্টার মত সিগন্যালে থাকতে হয়েছে।"
"এরপর শুরু হয় মূল ভোগান্তি। নয়াটোলা, মধুবাগের রাস্তায় পানি জমে গেছে, রিকশা-গাড়ি সব থেমে থাকছে বেশি, চলছে কম। আবার কখনো রাস্তার উল্টোপাশ দিয়ে বড় কোন গাড়ি ঢুকে আটকে গেছে গলির মুখে। রিকশা একটু এগুলে দশ মিনিট দাড়িয়ে থাকে। এভাবেই পৌনে ১১টার দিকে বাসায় ফিরি। সাধারণত আমি রিকশায় ৮০ টাকা ভাড়া দিয়ে ফিরলেও গতকাল ৩০০ টাকা ভাড়া দিয়েছি," বলেন তিনি।
রাত পৌনে ১১টার দিকে রাস্তায় থাকা শেখ সাব্বির নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন, "সড়কগুলোতে পানি জমে ছিল কোন কোন জায়গায় এক থেকে দুই ফুট। বিশেষ করে আমি যখন বাসায় ফিরি তখন দেখলাম শান্তিনগর মোড়ে দুই ফুটের মতো পানি জমে আছে। সেখানে কয়েকটি গাড়ি নষ্ট হয়ে দাড়িয়েছিল। সাত আটটা সিএনজি, একটা মাইক্রোবাস দাঁড়ানো দেখলাম।"
"নষ্ট গাড়িগুলোর জন্য শান্তিনগর মোড়ে জ্যাম হচ্ছিলো যথেষ্ট। সেখান থেকে এসে শাহজাহানপুর মোড়েও জ্যাম দেখলাম। অনেক মানুষ রাস্তার পাশে শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল," বলেন তিনি।
অত্যধিক বৃষ্টির পানিতে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতেও পানি ঢুকে পড়ে। এলিফ্যান্ট রোডে দোকানদারদেরকে রাতে বালতি দিয়ে দোকান থেকে পানি বের করতে দেখা গেছে।
বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় অনেকেই নিজেদের বাড়িতে না যেয়ে কাছাকাছি পরিচিত কারো বাড়িতে রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাছাড়া, সপ্তাহান্তে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ভ্রমণের জন্য বাস বা ট্রেনও মিস করেন অনেকে।
রাস্তায় পানি জমে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা যানবাহনগুলোর জন্য তীব্র জ্যাম সৃষ্টি হওয়ায় নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে সচরাচর সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ সময় লেগেছে নগরবাসীর।
জ্যামে আটকে থাকা অনেককেই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে তাদের অবস্থা জানাতে দেখা যায়।
অতিরিক্ত বৃষ্টিতে রাস্তার মাঝেই গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে পোস্ট করেন অনেকে।
তবে, জনমানুষের এতসব ভোগান্তিকে ছাপিয়ে যায় গতকাল একই পরিবারের তিনজন সহ চারজনের মৃত্যুর ঘটনা। মিরপুরে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে বৈদ্যুতিক তার পড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ওই চারজন।
ঢাকায় বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা নতুন চিত্র নয়। তবে গতকাল বৃষ্টি থামার ১৪ ঘণ্টা পরও আজ শহরের অনেক রাস্তায় পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।
ঢাকার আজিমপুর, নিউমার্কেট, বংশাল রোড, পুরান ঢাকার জুরাইন, বাড্ডা, মিরপুর-১২, মিরপুর-২, দক্ষিণখানসহ বেশ কিছু এলাকা এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে। অধিকাংশ এলাকার বাড়িঘর ও দোকানপাটে পানি ঢুকেছে।
অথচ, গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, অতিবৃষ্টি হলেও আগামী বর্ষায় ১৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
তখন তিনি বলেন, "রাজধানীর খালগুলো ওয়াসা থেকে হস্তান্তরের পরে প্রথম বছরে (২০২১ সাল) আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে পানি নিষ্কাশনে সফল হয়েছি। গত বছর আমরা আধা ঘণ্টার মধ্যে পানি নিষ্কাশনে সফল হয়েছি। এবার আমাদের লক্ষ্যমাত্রা হলো, অতিবৃষ্টি হলেও ১৫ মিনিটের মধ্যেই যেন ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে পারি।"
এদিকে, ঢাকা কলেজের ছাত্র ইমরান হোসেন আজ শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে নিউমার্কেটে যাওয়ার জন্য রওনা হন। তিনি বলেন, তিনি যে আবাসিক হলটিতে থাকেন তার সামনে হাঁটু পানি ছিল।
"এতটুকু রাস্তা যাওয়ার জন্য আমার ১৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে রিকশা নিতে হয়েছে," বলেন তিনি।
নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে পৌঁছে দেখেন, বাজারের অনেক দোকানেই পানি। তাছাড়া, এলাকার অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ।
কোনো কোনো ব্যবসায়ী ও দোকানের কর্মী কোনো রকমে ভিজে দোকানের সামনে গিয়ে বসে আছেন। দোকান খুলবেন কীভাবে তা বুঝতে পারছেন না। তবে নিউমার্কেটের উল্টোদিকে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে দু-একটি দোকান খোলা দেখা গেলেও সেখানে যাওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই।
নীলক্ষেতের সামনের সড়কে পানি জমে থাকার কারণে তেমন কোনো গাড়ি চলাচল করছে না। তবে সাধারণ মানুষ রিকশা ও ভ্যানে করে ওই সড়ক পারাপার হচ্ছেন।
ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশের গাউছিয়া, ধানমন্ডি হকার্স, বদরুদ্দোজা মার্কেটের বিক্রেতাদের দোকান থেকে পানি বের করতে দেখা গেছে। তাদের অনেক কাপড় ভিজে গেছে। বস্তায় থাকা কাপড় বের করে সড়কের পাশে রেখে তা পরিষ্কার করতেও দেখা গেছে অনেককে।
নিউমার্কেটের ভেতরসহ এই সড়কে পানি জমে থাকায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ফুটপাত ও নিউমার্কেটের ভেতরে থাকা হকাররা। তাদের অনেকের জিনিসপত্র সব ভিজে গেছে। বর্তমানে সেসব অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ারও কোনো উপায় নেই।
নিউ মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী ইয়াসিন মোল্লা টিবিএসকে বলেন, "দোকান খুলবো কেমন করে চারদিকে তো পানি। দোকানের নিচের কাপড় পানিতে ভিজে গেছে অনেকটাই। যদি পানি একটু কমে তাহলে দোকান খুলে বসা যাবে। দোকান না চললে তো আমাদের পেট চলবে না।"
দোকান খুলে বসে থাকা আর এক ব্যবসায়ী বলেন, "দোকান খুলে ভিতরের পানি পরিস্কার করেছি। রাতে বৃষ্টি দেখে নিচের মালামাল উপরে তুলে রেখেছিলাম তাই তেমন ক্ষতি হয়নি। দোকান খুললেও কাস্টমার নেই।"
নীলক্ষেত থেকে আজিমপুর সড়কে কোমরসমান পানি জমে আছে। এই সড়কে আজ বেলা ১১টার দিকে বেশ কিছু প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যানবাহন না পেয়ে মানুষ রিকশা ও ভ্যানে করে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন। আবার পর্যাপ্ত রিকশা-ভ্যান না পাওয়ায় অনেককে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
এদিকে, দোয়েল চত্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সড়কে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আছে। ওই সড়কে পানি জমে না থাকলেও ডাল ভেঙে থাকায় চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনে ঢাকা নার্সিং কলেজের ভেতরেও হাঁটুসমান পানি জমে আছে।
মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক থেকে নামার জায়গা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের অংশের সড়ক সকাল ১০টা পর্যন্ত পানির নিচে ছিল। ফুটপাত ছুঁই ছুঁই সেই পানি দুই পাশের দোকানিরা সেচে বের করার চেষ্টা করছেন।
এমনকি পানি নিষ্কাশনের জন্য শহরজুড়ে বসানো পানির পাম্পগুলোও খুব একটা কাজে আসেনি।
ঢাকা উত্তর এলাকায় জমে থাকা পানি নিরসনে বর্তমানে কল্যাণপুরে পাঁচটি পাম্প চালু রয়েছে উল্লেখ করে পাম্প অপারেটর মাসুম বলেন, "পাম্প এলাকায় পানির উচ্চতা বিপদসীমা ছাড়িয়ে ৫ মিটারে উঠেছে। যদি ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকে, তাহলে পাম্প করা ও পানি নিষ্কাশন করা চ্যালেঞ্জিং হবে।"
এদিকে আবহাওয়াবিদ ডক্টর মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক টিবিএসকে জানান, শুক্রবার রাত ১২টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়নি। তবে আগামী কয়েকদিন বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বাড়তে পারে।
আগামী তিন দিন বৃষ্টি হবে এবং এর পরিমাণ বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জায়গায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে।
এদিকে, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর দুপুর ১টায় তাদের ছয় ঘণ্টার আবহাওয়া বুলেটিনে জানিয়েছে, আজ ঢাকা ও আশেপাশের অঞ্চলে বজ্রসহ বা বিনা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।