অষ্টম শ্রেণি পাস ‘চিকিৎসক’, করতেন অস্ত্রোপচার!
নওগাঁর পোরশা উপজেলার চননারায়ন গ্রামের জাহিদুল ইসলাম ৮ মাস আগে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে সিজারের জন্য সততা ক্লিনিকে ভর্তি করেন। ক্লিনিকের পরিচালক মনিরুল ইসলাম স্বপন কথা দিয়েছিলেন জাহিদুলের পছন্দের সার্জনকে এনে অস্ত্রোপচার করাবেন।
কিন্তু রোগীর অবস্থা গুরুতর হতে লাগলে নানা অযুহাত দেখিয়ে মনিরুল নিজেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে অস্ত্রোপচার করেন। বাড়িতে আনার পর পেটে ইনফেকশন দেখা দেয় সেই নারীর। ইনফেকশনের কারণেই অতিরিক্ত ৩৫ হাজার টাকা খরচ গুনতে হয় জাহিদুলকে। শুধু জাহিদুল নন, ওই ক্লিনিকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ স্থানীয় অনেকের।
এমন প্রেক্ষাপটে মনিরুল ইসলাম স্বপনকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সনদ ছাড়াই টানা দেড় বছর অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অস্ত্রোপচার করার অভিযোগে এই দণ্ড দেওয়া হয় তাকে।
শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলা সদরের সততা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমে অভিযান চালিয়ে ওই ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্যাহ আল মামুন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অষ্টম শ্রেণি পাস মনিরুল দেড় বছর আগে অনুমোদন ছাড়াই উপজেলা সদরে সততা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোম খোলেন। এরপর সেখানে অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের অনুমতি চেয়ে সিভিল সার্জন অফিসে আবেদন করেন। নিয়মানুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি পরির্দশন করেন জেলা সিভিল সার্জন অফিসের প্রতিনিধি দল। তখন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ওই মুহুর্তে প্রতিষ্ঠানটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তবে থেমে যাননি মনিরুল ইসলাম। নিজেই ওই ক্লিনিকে সার্জনের ভূমিকায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অস্ত্রোপচার করতেন।
সম্প্রতি মনিরুলের অপারেশ থিয়েটারে অস্ত্রোপচারের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে ছবিটি পৌঁছায় জেলা প্রশাসকের কাছেও। এরপর জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে টনক নড়ে উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের। ওই প্রতিষ্ঠানে বেলা ১১ টার দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।
পোরশা উপজেলার চননারায়ন গ্রামের মোকছেদ বলেন, মনিরুল অবৈধ ক্লিনিক খুলে রোগীদের সাথে প্রতারণা করে জীবন নিয়ে খেলেছে। ওই ক্লিনিকে এখন পর্যন্ত যারাই গেছেন তারাই প্রতারিত হয়েছেন। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ দেখেও বিষয়টি না দেখার ভান করে থাকে। তবে মনিরুল যে অষ্টম শ্রেণি পাস এটা কেউ জানত না। তাই শুধুমাত্র ১ মাস কারাদণ্ড যথেষ্ট নয়। এদের মতো প্রতারকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়া উচিত বলে মনে করি।
সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্যাহ আল মামুন বলেন, ডিসি স্যারের নির্দেশনা পাওয়ার পর সকালে ওই ক্লিনিকে অভিযান পরিচালনা করলে জানা যায় ক্লিনিকটি অবৈধ। সেখানকার ৩ জন সিজারিয়ান রোগীর সাথে কথা বললে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। ওই তিনজন নারী ভর্তি হওয়ার পরই তাদের পরিবারের থেকে ফাঁকা কাগজে বন্ড সই নেওয়া হয়েছে। সিজারের সময় একজন গাইনী সার্জনের পাশাপাশি সেলাইসহ আনুষাঙ্গিক কাজে আরেকজন চিকিৎসক থাকার কথা। এর কোনটি ছাড়াই তাদের সিজার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গাইনী সার্জনের বিপরীতে অনভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে ওই ক্লিনিকে সিজার করা হয়। অ্যানেসথেসিয়াও করানো হয় অনভিজ্ঞদের দিয়ে। ডাক্তার সেজে সেলাইসহ আনুষাঙ্গিক কাজ করতেন ক্লিনিক পরিচালক মনিরুল। জিজ্ঞাসাবাদে মনিরুল অস্ত্রোপচারের অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করলে তাকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও সাত দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ক্লিনিকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রুহুল আমিন বলেন, অবৈধ ক্লিনিকটি চলছিল এটা জানতাম। তবে সেখানে ডাক্তারের বিপরীতে অষ্টম শ্রেণি পাস কেউ অস্ত্রোপচার করছে এমনটি জানা ছিল না। অভিযানে যাওয়ার পর মনিরুল কোনো ডাক্তারি সনদ দেখাতে পারেনি। এটা খুবই ভয়ানক একটি বিষয়। ক্লিনিকের অনুমোদন না থাকা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্স না থাকাসহ চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ক্লিনিকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতে থাকা ডা. রুহুল আমিন বলেন, মনিরুলের বাড়ি রাজশাহী। তিনি পোরশার এক নার্সকে বিয়ে করেন। এরপর তিনি নিজেকে চিকিৎসক দাবি করে কার্যক্রম চালান। এই কারণে হয়তো তার প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসতে দেরি হলো।
নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. রায়হানুজ্জামান সরকার বলেন, একজন সিভিল সার্জনের পক্ষে সবকটি উপজেলার ক্লিনিক দেখভাল করা সম্ভব না। এক বছর আগে ওই ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বরাবরই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে। এরপরেও সেটি চলমান থাকলে এ দ্বায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার।