আগামী বছর দেশের এলপিজি বাজারে সবচেয়ে বড় প্ল্যান্ট নিয়ে আসছে সিটি গ্রুপ
ঋণ পরিশোধ ও বিক্রি কমে যাওয়া নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কিছু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) অপারেটর। এই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্যেই দেশের বৃহত্তম এলপিজি প্ল্যান্ট তৈরি করতে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের সাহসী উদ্যোগ নিয়েছে অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠী সিটি গ্রুপ।
এই প্ল্যান্টটি তৈরি করা হবে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার হোসেন্দী অর্থনৈতিক অঞ্চলে।
এই উদ্যোগের পাশাপাশি শিল্পগোষ্ঠীটি বর্তমানে মোংলা ও চট্টগ্রামে দুটি প্ল্যান্ট অধিগ্রহণের জন্য আলোচনা করছে। দুটি প্ল্যান্টেই আমদানি টার্মিনাল রয়েছে।
এলপিজির ব্যবহার ক্রমেই রান্নাঘর ছাড়িয়ে শিল্প খাত, অটোমেটিভ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনেও পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে ক্রমেই বড় হচ্ছে এর বাজার। এই ক্রমবর্ধমান বাজারে সুদৃঢ় অবস্থান করে নেওয়াই সিটি গ্রুপের এই কৌশলগত পদক্ষেপের উদ্দেশ্য।
প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কমতে থাকায় বাড়ছে এলপিজির চাহিদা। তাই সিটি গ্রুপ বড় পরিকল্পনা করছে। এ শিল্পগোষ্ঠীর নতুন প্ল্যান্টটির স্টোরেজ সক্ষমতা হবে ১৬ হাজার টনের বেশি, যা দেশে সর্বোচ্চ। সিটি গ্রুপের কৌশল অনুসারে, বাড়তি প্ল্যান্ট দুটি সফলভাবে অধিগ্রহণ করা হলে এই সক্ষমতা ২০ হাজার টনের বেশি হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিটি গ্রুপের এলপিজি ইউনিটের প্রধান ফজলুর রহমান বলেন, 'আমাদের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে আমরা বাজারে প্রবেশের লক্ষ্য নিয়েছি।'
সিটি গ্রুপ তাদের ফ্ল্যাগশিপ ব্র্যান্ড 'তীর'-এর অধীনে তাদের এলপিজি পণ্য বাজারজাত করার পরিকল্পনা করেছে।
বর্তমানে বসুন্ধরা, ওমেরা, মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ (ফ্রেশ), বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপ ও জেএমআই গ্রুপের মতো শিল্প জায়ান্টসহ ২৯টি অপারেটর দেশে এলপিজি ব্যবসা করছে। এ তালিকায় এবার নাম লেখাতে চলেছে সিটি গ্রুপও।
ইতিমধ্যে ফ্রান্সের টোটালগ্যাজ, ডাচ পেট্রোম্যাক্স এবং হংকংয়ের কাই হেং লং গ্লোবাল এনার্জির মতো বিদেশি অপারেটরগুলোও এই দ্রুত প্রসারিত হতে থাকা বাজারে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশের এলপিজি বাজার উল্লেখযোগ্য হারে বড় হয়েছে। সরকার এখন সারা দেশেই আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে। এর সুবাদে এলপিজির বাজার ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ হারে বড় হচ্ছে।
বাজার অপারেটররা জানান, ২০১৩ সালে এলপিজির চাহিদা ছিল ৮০ হাজার টন; ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এই চাহিদা ১৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ এক দশকের মধ্যে এলপিজির চাহিদা বেড়েছে ১৫ গুণ। হিসাব অনুসারে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে এলপিজির চাহিদা ৩০ লাখ টনে পৌঁছতে পারে।
বর্তমান এলপিজি অপারেটরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্টোরেজ সক্ষমতা রয়েছে জেএমআই গ্রুপের, ১৪ হাজার টন। স্টোরেজ সক্ষমতার দিক থেকে এরপরেই আছে বিএমআই এনার্জি (১০ হাজার ৭০০ টন) ওমেরা (৯ হাজার ৬০০ টন) এবং বসুন্ধরা (৯ হাজার ৩০০ টন)।
হোসেন্দী প্ল্যান্টে সিটি গ্রুপের স্টোরেজ সক্ষমতা দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৫০০ টন। মোংলা ও চট্টগ্রামে আরও দুটি প্ল্যান্ট অধিগ্রহণের পরে গ্রুপটির স্টোরেজ সক্ষমতা বেড়ে প্রায় ২০ হাজার টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাজার হিস্যায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে বসুন্ধরা; এরপরই আছে ওমেরা, ইউনিগ্যাস যমুনা এবং ফ্রেশ। শীর্ষ ১০ কোম্পানির দখলে সম্মিলিতভাবে বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি হিস্যা রয়েছে। যদিও বেশ মোটা অঙ্কের ব্যাংকঋণের দায়ের কারণে কয়েকটি কোম্পানি এখন ক্রেতা খুঁজছে।
গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহসহ বাংলাদেশের এলপিজি শিল্পে মোট প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।
২০২২ সালে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পেট্রোম্যাক্স এলপিজি এবং পেট্রোম্যাক্স সিলিন্ডার অধিগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান এলপিজি বাজারে প্রবেশ করে নেদারল্যান্ডসের এসএইচভি এনার্জি।
বিনিয়োগের কারণ
বাণিজ্যিক ব্যবসা, শিল্প, পরিবহন, কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, রান্না, ঘর গরম করা এবং বিনোদনের মতো বিভিন্ন খাতে লাখ লাখ মানুষের চাহিদা পূরণ করছে এলপিজি। হাজার ধরনের ব্যবহার রয়েছে এর।
ঢাকার বাসাবাড়ির রান্নাঘর থেকে গাজীপুরের কারখানার রান্নাঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ, বান্দরবানের দোকান মালিকদের জন্য রেফ্রিজারেশন সরবরাহ, শহুরে যানবাহনের জন্য অটোগ্যাস সরবরাহ এবং পুরান ঢাকায় ওয়েল্ডিংয়ের কাজেও রয়েছে এলপিজির ব্যবহার। এরকম অভিযোজন-সক্ষমতা এবং হরেক ধরনের চাহিদা পূরণ করতে পারার জন্যই এলপিজি হয়ে উঠেছে অপরিহার্য।
প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমহ্রাসমান মজুতের কারণে বাংলাদেশ সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে ২০০৮ সাল থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন আবাসিক সংযোগ বন্ধ রেখেছে। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকবার আবাসিক সংযোগ দেওয়া শুরু করার চেষ্টা করা হলেও, সরবরাহের ঘাটতির কারণে এ প্রচেষ্টা সফল হয়নি।