‘একটা মাছিও ঢুকতে দেব না’, ঢুকে পড়ল হাজারো জামায়াত কর্মী! ২৮ অক্টোবর এক প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা
২৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টায় পৌঁছালাম আরামবাগে। সেখানে তখন বিএনপির কর্মীরা ফেস্টুন হাতে স্লোগান দিচ্ছেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখার পর মনে হলো এখানে জামায়াতের কর্মীও আছেন। তাদের পরনের পোশাক (টুপি, পাঞ্জাবি) দেখে এ ধারণা হলো।
সকাল ১০টার দিকে পুলিশ হাজির হলো কাভার্ডভ্যানে বেশ কিছু রাস্তা ব্যারিকেডের সরঞ্জাম নিয়ে। মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে আরামবাগ পর্যন্ত দুটি ব্যারিকেড দেওয়া হলো চটজলদি। দুই ব্যারিকেডে দুই শতাধিক পুলিশ অবস্থান্ নিল, মাঝের জায়গায় আরও দুইশ পুলিশ। সবমিলে প্রায় পাঁচশ পুলিশ হবে ধারণা করলাম। এছাড়া পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়ি, জলকামান, এপিসি এখানে অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে আরামবাগ থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত দুজন এএসপিকে দেখলাম পঞ্চাশজনের মতো পুলিশ নিয়ে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চক্কর দিচ্ছেন। শাপলা চত্বরের দিক থেকে আসা বিএনপি কর্মীদের একত্র হতে বাধা দিচ্ছেন তারা। তাদেরকে পুলিশের তরফ থেকে জানানো হচ্ছে, 'বিএনপির লোক এখানে (নটর ডেম কলেজের দিকে) থাকবে না। তোমরা তোমাদের সমাবেশস্থলে যাও।'
সকাল ১০টা ২০ মিনিট। নটর ডেম কলেজের সামনে বেশ কিছু পাঞ্জাবি পরা ও সাধারণ কর্মীরা অবস্থান নিলে পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর কয়েকজন কনেস্টেবলকে নিয়ে তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন। বললেন, এখানে কোনো জামায়াত-শিবিরের অবস্থান হবে না। পুলিশের তৎপরতায় তখন মনে হচ্ছিল, জামায়াত এখানে সমাবেশ করতে পারবে না।
গত দুই সপ্তাহে দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ২৮ অক্টোবর। এদিন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও কার্যত বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের মিত্র দল জামায়াতে ইসলামী ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দেয়।
২৭ তারিখ রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'শাপলা চত্বরেই সমাবেশ হবে' এমন প্রচারণা চালান জামায়াত নেতাকর্মীরা। সারাদেশ থেকে আসা কর্মীদের যথাস্থানে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রধান দুই দলের সমাবেশের অনুমতি মিললেও, জামায়াতের ক্ষেত্রে প্রশাসন ছিল ভিন্ন অবস্থানে। জামায়াতকে সমাবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল।
তবে শেষে কোনো অনুমোদন না থাকলেও জামায়াত সমাবেশ করতে সক্ষম হয়।
'স্যার একটি মাছিও ঢুকতে দেব না'
আরামবাগ মোড় থেকে কমলাপুরের রাস্তা খুব দ্রুতই জামায়াত কর্মীতে ভরে যায়। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যেই জামায়াত-শিবিরের অন্তত ১০ হাজার কর্মী জড়ো হয়ে যায় সেখানে। চারদিক থেকে তখন জামায়াতের থেমে থেমে স্লোগান চলছে। তখন পর্যন্ত পুলিশ তাদের আগের অবস্থানেই অনড়। কারণ তখন পুলিশ সমাবেশ করতে না দেওয়ার জোরালো অবস্থানে।
সকাল ১১টা। আরামবাগ থেকে পুলিশ লাইন হাসপাতালের মোড় পর্যন্ত সড়কে তখন (আনুমানিক) জামায়াতের প্রায় ৩০-৪০ হাজার কর্মী জড়ো হয়ে গেছে।
দেখলাম, দুই থেকে তিন হাজার জামায়াত ও শিবিরকর্মী (স্বেচ্ছাসেবক) একেকজনের হাত ধরে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছেন; পুলিশের সঙ্গে শুধু পুলিশের ব্যারিকেড।
খেয়াল করলাম: তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবী নিয়ন্ত্রণ করছেন মাত্র চার-পাঁচজন যুবক। এদের বয়স আনুমানিক ২৫-৩০ বছর বড়জোর। তারা যে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেটিই তাৎক্ষণিকভাবে পালন করছেন বাকিরা।
উপস্থিত কয়েকজন কর্মীকে জিজ্ঞেস করে তাদের পরিচয়, পদ জানার চেষ্টা করলাম। তখনই পরিষ্কার জবাব না পেলেও পরে কথা বলে জেনেছি, তাদের একজন শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি।
১১টা ১৫ মিনিট। পুলিশের একজন এডিসির ওয়াকিটকিতে তার ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে কথোপকথন কানে এলো: 'জি স্যার, হ্যাঁ, স্যার। একটা মাছিও ঢুকতে দেব না।' বুঝলাম সংঘর্ষ বাধতে যাচ্ছে জামায়াত-পুলিশের মধ্যে।
২৬ তারিখ প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল জামায়াত সমাবেশ করতে পারবে না। কিন্তু আরামবাগে বিপুল জামায়াত নেতাকর্মী জড় হয়ে গেছে, আরো আসছে, পুলিশ সতর্ক কিন্তু কোনো ধরপাকড়ের দৃশ্য তখনও আমার চোখে পড়েনি।
জামায়াত সমাবেশ না করে যাবে না, সেটি তাদের কথায়ই বোঝা যাচ্ছিল। আরামবাগ মোড়ের পুলিশ বক্সে অবস্থানরত পুলিশের একজন ডিসির সঙ্গে শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলোয়ার হোসন ও হাইকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামাল গিয়ে কথা বলছেন দেখলাম।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম পুলিশের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেরিয়ে এলেন। অন্যন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ চলল কিছুক্ষণ। তারপরই পুলিশের কঠোর মনোভঙ্গিতে মনে হলো পরিবর্তন এলো।
এরপর দেখলাম, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে চারটি কাভার্ডভ্যান আরামবাগ মোড়ে চলে এসেছে। তাতে মঞ্চ তৈরির সরঞ্জাম। দুটি ট্রাকে জামায়াতের সমাবেশের মঞ্চ তৈরি হলো। আর দুটি ট্রাকে মিডিয়ার লোকজনের স্থান হলো। মঞ্চেও দ্রুতই নেতাকর্মীরা উঠে পড়লেন।
১২টা থেকে সাড়ে ১২টা। এই সময়ের মধ্যে মনে হলো লক্ষাধিক জামায়াত সমর্থক সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়ে গেছে। সমাবেশেই নির্দিষ্ট জায়গায় একজন ইমামের নেতৃত্বে নামাজও আদায় হলো। এ সময় পুলিশকে শিথিলই মনে হলো।
হঠাৎ শাপলা চত্বরের ব্যারিকেড যেভাবে ভাঙলেন জামায়াত কর্মীরা
পুলিশের অধিকাংশ কর্মীই আরামবাগ ব্যারিকেডের দিকে অবস্থান নিয়েছিলেন। শাপলা চত্বরের দিকের ব্যারিকেডে ছিলেন শখানেক পুলিশ। হঠাৎ কয়েক হাজার জামায়াত কর্মীর একটি মিছিল নিয়ে পেছন দিক দিয়ে এসে ব্যারিকেড ভেঙে ফেললেন। স্লোগান দিতে দিতে আরামবাগের দিকে এগোতে শুরু করলেন তারা। এ সময়ে এই বিপুলসংখ্যক জামায়াত কর্মীর মিছিলে পুলিশ সদস্যরা বাধা না দিয়ে বরং রাস্তার এক পাশে সরে এলেন।
ওদিকে পুলিশ আরামবাগ এলাকা থেকেও পিছু হটে গেছে ততক্ষণে। আরামবাগ থেকে সরে নটর ডেম কলেজের শেষ সীমানার কাছে এসে অবস্থান নিয়েছে তারা। আরামবাগ থেকে নটর ডেম কলেজের শেষ মাথা পর্যন্ত পুরো এলাকা জামায়াতের নেতাকর্মীরা দখলে নিয়ে নিয়েছেন।
জামায়াতের স্বেচ্ছাসেবীরা পুলিশের ব্যারিকেডের কাছে চার স্তরের নিজস্ব ব্যারিকেড তৈরি করে ফেলেছেন দেখলাম। এক স্তরে প্রায় কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবী একে অপরের সঙ্গে মিশে পুলিশের মুখোমুখি অবস্থানে।
জামায়াতের ব্যারিকেড ভাঙা নিয়ে পুলিশের এএসপি শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রাশেদুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করার কথা জেনেছি, তিনি তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তারা তো অঙ্গীকার করেছিলেন মতিঝিলের দিক থেকে তাদের কোনো লোক ঢুকবে না। সেটা কেন মানলেন না?
ব্যারিকেড ভাঙার পরও পুলিশ স্বাভাবিক অবস্থানেই থাকে। পুরো সমাবেশের সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে জামায়াতের কিছু নেতাকে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলতে দেখা যায়।
দুপুর আড়াইটা। মতিঝিল থেকে আরামাবাগ, আরামবাগ থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পুরো এলাকায় প্রায় দুই লাখের বেশি জামায়াত নেতাকর্মী অবস্থান নিয়েছেন। উপস্থিতির এই সংখ্যা দলটির একজন নেতা নিশ্চিত করেন আমাকে।
সাউন্ড গ্রেনেডের বিরুদ্ধে জামায়াত আমিরের কৌশল
দুপুর আড়াইটা থেকে বেলা ৩টা ১৫ পর্যন্ত জামায়াত নেতা আব্দুর রহিম মুসা, শফিকুল ইসলাম মাসুদ, এটিএম মাসুম, শিবির সভাপতি রাজিবুর রহমান পলাশ, আব্দুল হালিম, হামিদ হোসেন আজাদ, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বক্তব্য রাখেন।
তারা সরকারের নানা সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃতিষ্ঠা, সরকারের পদত্যাগ, জামায়াতের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানান। একইসঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান। তাদের বক্তব্যের সময় নেতাকর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তোলেন।
প্রধান অতিথি জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মজিবুর রহমান বক্তব্য রাখেন সোয়া তিনটার দিকে। তিনি ঘোষণা করেন, জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করতে দেবে না।
তার বক্তব্য চলাকালে বেলা ৩টা ২৫ মিনিটের দিকে কাকরাইল এলাকা থেকে সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ আসতে থাকে। আকাশে কালো ধোঁয়ায় ভরে যেতে থাকে। সঙ্গে একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজ আসতে থাকে। তখন সভার নেতাকর্মীদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটতে শুরু করলে জামায়াতের আমির তার বক্তব্য আরও জোরালো করতে শুরু করেন। তিনি সাড়ে ৩টায় কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করে বক্তব্য শেষ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষেই জামায়াতের মহানগরী আমির সমাবেশের দ্রুত সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এ সময় নেতাকর্মীরা আরামবাগের রাস্তা দিয়ে কমলাপুর ও শাহজানপুর হয়ে সমাবেশস্থল ত্যাগ করেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অর্থনীতি বিটের একজন প্রতিবেদক হওয়ার সুবাদে মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় আমাকে যেতে হয় প্রতিদিনিই। সেদিন শনিবার হওয়ায় ব্যাংক বন্ধ থাকায় জামায়াতের সমাবেশের অ্যাসাইনমেন্ট আমাকে দেওয়া হয়। সেই বিরল এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকলাম।