ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি: বাড়ছে ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্বের ঝুঁকি
"ডান চোখে একদম দেখতে পারিনা। বাম চোখে আলোর মত কিছু একটা দেখি কিন্তু কী বা কাকে দেখছি তা বোঝা যায়না"-বলছিলেন উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা সাধারণ বীমা করপোরেশনের সাবেক কর্মী লাল মিয়া (৬৬)। ২০০৬ সালে ডায়াবেটিস শনাক্ত হয় তার। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত লাল মিয়ার ডান চোখ অন্ধ হয়ে গেছে আর বাম চোখে ৩০% দেখতে পারেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চোখের এমন একটি রোগ যার ফলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায় এমনকি অন্ধত্বও হতে পারে।
বাম চোখে লেজার ট্রিটমেন্ট নিতে ১৯ অক্টোবর সকালে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালে আসেন লাল মিয়া। সেখানেই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ১৭ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন তিনি।
"ডায়াবেটিস থেকে হার্টের সমস্যা হয়েছে আমার। কিন্তু এর আগে চোখের ডাক্তার দেখাইনি। দেড় মাস আগে এই হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর পর বৃহস্পতিবার লেজার করার সিরিয়াল পেয়েছি," বলেন তিনি।
গত বুধবার (১৮ অক্টোবর) অফিসে কাজ করতে করতেই হঠাৎ করে বাম চোখে একেবারেই দেখতে পাচ্ছিলেন না রাাজধানীর একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউনটেন্ট আনোয়ার হোসেন (৫৭)।
পরদিন রাজধানীর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ডাক্তার দেখিয়ে লেজার নেন তিনি। ২০০৮ সাল থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আনোয়ার হোসেন এর আগে ২০২০ সালে বসুন্ধরা আই হসপিটালে ডান চোখে লেজার করেন। ডায়াবেটিস থেকে হার্টের সমস্যা ও কিডনিতে সমস্যা হয়েছে তার।
লাল মিয়া ও আনোয়ার হোসেনের মতো অনেকেরই ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্ব দেখা দিচ্ছে। এমনকি চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের রেটিনা ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা ৫০% রোগী ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথিতে ভুগছে।
হাসপাতালের লেজার রুমে প্রতিদিন গড়ে ১২ জনকে লেজার চিকিৎসা দেওয়া হলেও রোগীর চাপ অনেক বেশি। সেজন্য লেজারের সিরিয়াল পেতে দেড় থেকে দুই মাস অপেক্ষা করতে হয় রোগীদের।
চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১.৩ কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্তদের অন্ধত্বের প্রধান কারণ হলো ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চোখের পেছনে অবস্থিত আলো-সংবেদনশীল টিস্যু রেটিনার রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ রোগে সাধারণত দুই চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং সঠিক চিকিৎসা না করা হলে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে পারে। রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ে।
বিশ্বব্যাপী মানুষের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে কাজ করা সংস্থা অরবিজের মতে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ লোককে প্রভাবিত করে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। ৩৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্ধত্ব এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের প্রধান কারণ এটি।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস এর পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় ১.৮৫ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত।
অন্ধত্বের ঝুঁকি কমাতে ডাক্তাররা ডায়াবেটিস রোগীদেরকে বার্ষিক রেটিনাল পরীক্ষার পরামর্শ দেন।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের দীর্ঘমেয়াদী ফেলো ডা. আতিকুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সাধারণত ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার দশ বছর পর ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি হওয়ার ঝুঁকি শুরু হয়। আর্লি স্টেজে রোগটি শনাক্ত হলে ঝুঁকি কমে।"
"আমাদের হাসপাতালে লেজার নিতে যে রোগীরা আসে তারা সবাই অ্যাডভান্স স্টেজের রোগী। লেজার দিলেই তারা দেখতে পারবে- বিষয়টা তা নয় হবে অন্ধ হওয়ার ঝুঁকি এতে কমে। এক বছরের মধ্যে যিনি অন্ধ হয়ে যেতেন, এখন তিনি হয়তো দশ বছর মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারবেন।"
"ডায়বেটিস রেটিনোপ্যাথি প্রতিরোধে ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার পর রোগীদের প্রতি বছর একবার করে চোখের রেটিনা পরীক্ষা করতে হবে। ডায়াবেটিস, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখলে এর ঝুঁকি কমবে," বলেন তিনি।
দেশে ডায়বেটিস রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত রোগী কত তার নির্দিষ্ট কোন তথ্য না থাকলেও রোগের পরিসর যে বাড়ছে তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।
২০২৩ এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাদুর্ভাব ছিল ১৮.৮%। বাংলাদেশের ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগের ৪৮৯ জন রোগীর ওপর এ গবেষণা চালানো হয়। এদের সবার টাইপ-২ ডায়াবেটিস ছিল।
"ট্রেন্ডস ইন ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, ভিজুয়াল অ্যাকুইটি অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট আউটকামস ফর পেশেন্টস লিভিং উইথ ডায়াবেটিস ইন আ ফান্ডাস ফটোগ্রাফ বেইসড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ" শীর্ষক আরেকটি গবেষণা চালানো হয় একটি ডায়াবেটিক এবং দুটি চক্ষু হাসপাতালে। সাত বছর ধরে পরিচালিত এ গবেষণা চালানো হয় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৪৯,২৬৪ জন রোগীর ওপর।
২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, তিনটি হাসপাতালেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি প্রাদুর্ভাবের হার ছিল ৩৩%। আরও দেখা যায়, নারীদের তুলনায় পুরুষরা এর ঝুঁকিতে থাকে বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষুবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (ভিট্রিও-রেটিনা) ড. মোহাম্মদ আফজাল মাহফুজুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, পৃথিবীতে যেসব কারণে অন্ধত্ব হয়, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি তার অন্যতম কারণ। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ধরা পড়লে তা একদম সারানো যায় না। তবে নিয়মিত চিকিৎসা, থেরাপি ও পরীক্ষার মাধ্যমে চোখের ক্ষতি এড়ানো যায়।
তিনি বলেন, "ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি গুরুতর পর্যায়ে গেলে অপারেশন বা লেজার থেরাপি ছাড়া উপায় থাকে না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে বছরে একবার রেটিনা পরীক্ষা করাতে হবে।"
বর্তমানে সারাদেশে ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথির হার নির্ণয়ে গবেষণা করছে (বিএসএমএমইউ)।
এ গবেষণার অন্যতম গবেষক ড. আফজাল জানান, জামালপুর, শেরপুর, ট্রাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, রামু, কক্সবাজার সহ বেশ কয়েটি উপজেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
"গবেষণা শেষে আমরা বুঝতে পারবো দেশে কত মানুষ এ রোগে আক্রান্ত, এটি প্রতিরোধে কী করতে হবে, যাদের ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি হয়ে গেছে তাদের জন্য কী ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে," বলেন তিনি।