নতুন তিন রেললাইন চালু হচ্ছে, কিন্তু নেই পর্যাপ্ত জনবল ও রোলিং স্টক
লোকোমোটিভ, কোচ, ওয়াগন ও জনবলের তীব্র সংকটের মধ্যেই নতুন তিন লাইনে—দোহাজারী-কক্সবাজার, খুলনা-মোংলা বন্দর ও কমলাপুর-ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক—রেলসেবা চালু করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বছরের পর বছর ধরে এসব সংকটে ব্যাহত হচ্ছে রেলওয়ের সেবা।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, ৩৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তিনটি নতুন রেললাইনের রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবা পরিচালনায় ৩ হাজার ৫০০-র বেশি নতুন পদ সৃষ্টি করতে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়।
এ অবস্থায় রেলের অন্যান্য সেকশন থেকে লোকবল বদলির মাধ্যমে নতুন এই তিন লাইনে সেবা চালুর পরিকল্পনা করছে রেলওয়ে।
এ পরিস্থতিতে বিদ্যমান জনবল দিয়ে ৬২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা বিনিয়োগে তৈরি করা নতুন রেললাইনে সেবা পরিচালনা কঠিন হবে বলে মনে করছেন গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে রেলের অন্যান্য সেকশনেও সেবার মান কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র বলছে, সংস্থাটির অনুমোদিত জনবল কাঠামোর ২৩ হাজারের বেশি পদ এখনও খালি রয়েছে। জনবল সংকটে সেবার আওতায় থাকা এক-চতুর্থাংশের বেশি স্টেশন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
অন্যদিকে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৪৩টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৪৪ ট্রেনের রুটের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে সংস্থাটির মোট লোকোমোটিভের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২২টি। ৩০৮টি লোকোমোটিভের মাধ্যমে প্রতিদিন ৪০২টি ট্রেন পরিচালনা করতে হয়। এর মধ্যে ডজনের বেশি লোকোমোটিভ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ায় সময়মতো ট্রেন পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, প্রায় ৬০ শতাংশ লোকোমোটিভ, ৪৭ শতাংশ যাত্রীবাহী কোচ ও ৬৭ শতাংশ ওয়াগনের অর্থনৈতিক জীবনকাল শেষ হয়ে গেছে।
সংকটের কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেন, লাইন নির্মাণের সঙ্গে সংগতি রেখে রোলিং স্টক সরবরাহ ও জনবল নিয়োগের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারেনি রেলওয়ে।
তিনি জানান, এর ফলে শুরুতেই নতুন লাইনগুলোতে পূর্ণাঙ্গ রেলসেবা দিতে পারবে না রেলওয়ে। প্রাথমিকভাবে বিদ্যমান জনবল ও রোলিং স্টক দিয়ে সেবা চালু করা হবে। পরে জনবল ও রোলিং স্টক বৃদ্ধি সাপেক্ষে নতুন লাইনগুলোতে ট্রেনের সংখ্যাও বাড়বে।
নতুন লাইনগুলোতে রিসোর্স সংকট
গত ১০ অক্টোবর কমলাপুর থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার রেললাইনের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১ নভেম্বর থেকে এই লাইনে বাণিজ্যিক রেলসেবা শুরু হয়েছে।
এ মাসের প্রথম দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে খুলনা-মোংলা বন্দর সংযোগ এবং দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনও উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী আগামী ১৩ নভেম্বর দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন করবেন বলে জানানা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিরাজ-উদ-দৌলা খান।
রেলওয়ে প্রকল্পের নথি অনুসারে, নতুন তিনটি লাইনে দিনে ৬০টি যাত্রীবাহী ও ২২টি পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা করা হবে। এর জন্য অন্তত ৩৬টি নতুন লোকোমোটিভ প্রয়োজন হবে।
নতুন তিনটি লাইনে ট্রেন পরিচালনায় যাত্রীবাহী ৪০৮টি কোচের চাহিদার বিপরীতে পদ্মা রেল লিঙ্ক প্রকল্পের আওতায় মাত্র ১০০টি কোচ কেনা হয়েছে। এর মধ্যেই কিছু কোচ অন্যান্য লাইনের ট্রেনে যোগ করা হয়েছে।
এর সঙ্গে দোহাজারী-কক্সবাজার লাইনে ২২৫টি ও পদ্মা সেতুর লাইনে ১৫০টি মিলিয়ে দুই লাইনে পণ্য পরিবহন করতে নতুন ৩৬৫টি ওয়াগনের প্রয়োজন হবে।
এ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি ব্রডগেজ কোচ কেনা করা হয়েছে, আরও ২০০টি মিটারগেজ কোচ ক্রয় প্রক্রিয়াধীন আছে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, অবকাঠামো নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের যতটা আগ্রহ আছে, তার তুলনায় অনেক কম আগ্রহ এই অবকাঠামো ব্যবহার করে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করায়।
মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা না গেলে লাইন নির্মাণে জনগণের তহবিলের বিশাল বিনিয়োগ অপচয়ে পরিণত হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
শামসুল হক আরও বলেন, ট্রেনের গতি বাড়ানো গেলে বিদ্যমান রোলিং স্টক ব্যবহার করেও সেবার মান বাড়ানো সম্ভব। তিনি বলেন, ৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো হলে যে পরিমাণ রোলিং স্টক লাগে, ১০০ কিলোমিটার গতিতে চালানো হলে রোলিং স্টক লাগবে অর্ধেক। অন্যভাবে বললে, ট্রেনের গতি দ্বিগুণ করে একই পরিমাণ রোলিং স্টক ব্যবহার করে দ্বিগুণ সেবা দেওয়া যায়।
জনবল সংকটে সেবাও লাইনচ্যুত
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, বর্তমানে রেলওয়ের অপারেশনাল জনবল, যেমন স্টেশন মাস্টার, লোকো মাস্টার (চালক), পোর্টার, লেভেলক্রসিং গেইটম্যান ইত্যাদি জনবল সংকটে রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়েতে এখন মোট ৪৭ হাজার ৬৩৭টি পদ রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ২৪ হাজার ৫০০ জনবল কাজ করছেন। অনুমোদিত পদের বিপরীতে জনবলের ঘাটতি আছে ২৩ হাজার ১৩৭ জন।
পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানান, গত বছরের মে মাসে তিনটি নতুন লাইনের জন্য নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হলে সেই প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনও পদ সৃষ্টির অনুমোদন পাওয়া যায়নি। নতুন পদ সৃষ্টি না করে বিদ্যমান জনবল দিয়েই সেবা পরিচালনা করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে রেলওয়েকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, নতুন জনবলের অনুমোদন না নিয়ে রেলওয়ের উচিত অনুমোদিত অর্গানোগ্রামের সবগুলো পদে নিয়োগ নিশ্চিত করা।
বিপুল পরিমাণ জনবল নেওয়া হলেও প্রচলিত ব্যবস্থায় রেল পরিচালনা লাভজনক করা কঠিন হবে বলে মনে করেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ। রেল পরিচালনায় বেসরকারি অপারেটরদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিন।
কেনাকাটায় ধীরগতি
কর্মকর্তারা বলছেন, রোলিং স্টক ক্রয়ের প্রকল্পে ধীরগতির কারণে রেলওয়ে লোকোমোটিভ এবং কোচ সংকটে পড়েছে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, মূলত ২০০ কোচ কেনাসহ বেশ কিছু প্রকল্পে জটিলতার কারণে রেলওয়ে এ সংকটে পড়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে 'বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন (রোলিং স্টক সংগ্রহ)' প্রকল্পের আওতায় ৪০টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ, ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান এবং ৫৮০টি মিটারগেজ ও ৪২০টি ব্রডগেজ ওয়াগন সংগ্রহ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (ইআইবি) অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের কাজও চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
২০১৬ সাল থেকে চলমান ২০০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ ক্রয় প্রকল্পে ৯২৮ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে গত মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকা। আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চীনের অর্থায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় নতুন উৎসের ঋণ খুঁজছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
১ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকায় ২০১৭ সাল থেকে চলমান ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ এবং ১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ প্রকল্পেও প্রত্যাশিত গতি নেই।
তিনবার মেয়াদ বাড়ানোর পরও এই প্রকল্পে এ পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৮৪.২১ শতাংশ। একইভাবে রেলের ক্রয়-সংক্রান্ত আরও বেশ কিছু প্রকল্পে ধীরগতি রয়েছে।
মানা হচ্ছে না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
২০১৬ সালের মার্চে দেশের সমস্ত বন্ধ রেলস্টেশন পরবর্তী এক বছরের মধ্যে চালু করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে এই নির্দেশ পালন করা যায়নি বলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লোকবল স্বল্পতার কারণে আরও ১১৮টি রেলস্টেশনের দৈনন্দিন কার্যক্রম এখন সাময়িক বন্ধ রয়েছে। রেলস্টেশনের কার্যক্রম পরিচালনা-সংশ্লিষ্ট পদে লোকবল নিয়োগ কার্যক্রম চলমান আছে দাবি করে এতে আরও বলা হয়, নিয়োগ প্রদানপূর্বক অবশিষ্ট বন্ধ রেলস্টেশনগুলো চালু করা হবে।
২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ঢাকা-লালমনিরহাট আন্তঃনগর ট্রেনটি বুড়িমারী পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে তা পূরণ হয়নি।