আজ দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী
আজ (১১ নভেম্বর) দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের কক্সবাজারের সাথে প্রথম রেল সংযোগ, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলসংযোগ এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজীপাড়ায় আইকনিক ঝিনুক আকৃতির রেলওয়ে স্টেশনটি উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো উপকূলীয় শহর কক্সবাজারের সঙ্গে অনুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
এ অঞ্চলকে আরও উন্নত এবং বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে সরকার এই রেললাইন স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয়। স্টেকহোল্ডাররা বলছেন, নতুন রেললাইনের মাধ্যমের পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহজে ও সাশ্রয়ী উপায়ে কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
রেললাইন উদ্বোধন ছাড়াও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আজ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের ১৪.৩ কিলোমিটার চ্যানেলসহ ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং চারটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
জেলা প্রশাসকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এদিন প্রধানমন্ত্রী রেলওয়েসহ ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
দুপুর আড়াইটায় মহেশখালীর মাতারবাড়িতে এক সমাবেশে তার বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে কক্সবাজার শহরের প্রধান পয়েন্টগুলোতে ও রাস্তার দুই পাশে লাগানো হয়েছে ব্যানার, ফেস্টুন এবং বিলবোর্ড।
শহরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান জানান, এ অনুষ্ঠানকে সফল করতে তারা সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন।
নতুন যুগের সূচনা
১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথের এই প্রকল্পটি বাণিজ্যিকভাবে চালু হলে বদলে যাবে এ অঞ্চলের দৃশ্যপট। ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কারখানা, পর্যটন খাতে আসবে আমূল পরিবর্তন।
শুধু তাই নয়, কক্সবাজরজুড়ে ২৫টি মেগা প্রকল্পসহ মোট ৭৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এতে বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। রেল লাইন, গভীর সমুদ্র বন্দর, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ট্যুরিজম, আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর, অবকাঠামোসহ নানান খাতের এসব প্রকল্প একে একে উদ্বাধন হতে চলেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাল্টে যাচ্ছে দেশের প্রধান পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের দৃশ্যপট।
রেলপথ, লজিস্টিকস, কানেকটিভিটি, সড়ক পথ নির্মাণের ফলে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম হয়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার বিজনেস হাব। চট্টগ্রামের সাথে রামগড়ের স্থলবন্দর হয়ে ভারত, মিয়ানমার হয়ে চীনের সাথে রেল লাইন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলের সাথে স্থলপথে ট্রানজিটের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মৎস, লবণ, শুটকি, সবজিসহ নানান শিল্পের জন্য সহায়ক হবে এই রেল যোগাযোগ। যে নয়টি স্টেশন রয়েছে, সেসব উপজেলাতেও কর্মচঞ্চলতা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে।"
অর্থনীতির প্রধান গেম চেঞ্জার– মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর
'বিগ বি' ধারণার আলোকে জাপানের সংস্থা জাইকা ২০১৬ সালে এক জরিপের মাধ্যমে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য স্থান চিহ্নিত করে। বর্তমানে সেখানে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
বন্দর সংশ্লিষ্ট এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। ২০২৬ সালে মাদার ভেসেল ভিড়ানোর মধ্য দিয়ে মেরিটাইম বিশ্বে মহেশখালীর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর সৃষ্টি করবে নতুন মাইলফলক।
বাংলাদেশের প্রধান আমদানিস্থল চীনসহ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যে মেলবন্ধনের নিয়ামক হয়ে উঠবে জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে হতে যাওয়া মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারেনে বিধায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ আমদানি পণ্য মাদার ভেসেলে সিঙ্গাপুর, কলম্বো, হংকং বা মালয়েশিয়ায় পৌঁছে সেখান থেকে ফিডার ভেসেলে করে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে আসে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়ন হলে যেকোনো দেশ থেকে মাদারভেসেল এ বন্দরে নোঙর করতে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান হাইড্রোগ্রাফার এম আরিফুর রহমান বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরটি সম্পন্ন হলে ৩৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৮ মিটার ড্রাফটসহ বিশ্বের যেকোনো জাহাজ সেখানে নোঙর করতে পারবে।
লাইটার জাহাজগুলো তখন মাতারবাড়ি থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ও বে টার্মিনালে পণ্য পরিবহন করবে; এতে সময় ও খরচ কমার পাশাপশি পণ্য পরিবহনের গতি বাড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, "পোর্ট কেলাং, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য বন্দরের মতো মাতারবাড়ি ট্রানজিট পোর্ট হবে। ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বন্দরের সাথে নতুন রুট চালু হবে। এই বন্দর দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের বিজনেস হাব হিসেবে আবির্ভূত হবে। এতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে বাংলাদেশের।"
কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে দেবে রেললাইন ও বিমানবন্দর
এতদিন পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাতায়াতের প্রধান রুট ছিল সড়ক পথে। চট্টগ্রাম থেকে দুই লাইনের সড়ক পথ পাড়ি দিতে ছিল পথে পথে ভোগান্তি। বাসের চেয়ে তুলনামূলক প্রায় অর্ধেক খরচে রেলপথেই এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একই সাথে কক্সবাজার টেকনাফ অঞ্চলে ট্যুরিজম খাতে সরকারের একগুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই রেলপথের গুরুত্ব আরও বাড়বে।
সমুদ্র, ঝাউবন, ঝর্ণা আর দিগন্ত ছোঁয়া পাহাড়ের রূপ দেখতে প্রতিবছর ৬০-৭০ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে আসেন। তবে এরমধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। বিদেশিদের আকৃষ্ট করতেই ঢেলে সাজানো হচ্ছে টেকনাফের সাবরাং, নাফ ও মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ। দেশে প্রথম দ্বীপভিত্তিক পর্যটন নির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)।
সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠায় সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টার এশিয়া গ্রুপ প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ভূমি ইজারা চুক্তি সই করে বেজা।
টেকনাফ শহরের অদূরে নাফ নদীর মোহনায় জালিয়ার দ্বীপ ঘীরে নাফ টুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। দেশে প্রথমবারের মতো কেবল কার যুক্ত হবে এই ট্যুরিজম পার্কে। নাফ ট্যুরিজম পার্কের কাজ শেষ হলে কর্মসংস্থান হবে ১২ হাজার মানুষের। এছাড়া, সমুদ্রদ্বীপ সোনাদিয়ায় ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনেরও একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বেজা।
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা সরাসরি কক্সবাজারে আসা-যাওয়া করতে পারবেন। আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে রূপান্তর করতে রানওয়ের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে। সমুদ্রের ওপরে ১,৭০০ ফুট রানওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। এই অংশের কাজ শেষ হলে কক্সবাজার বিমানবন্দর হতে সকল ধরনের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা এবং সব ধরনের বিমান উঠানামা করতে পারবে।
বঙ্গোপসাগর তীর ঘিরে চলছে উন্নয়নযজ্ঞ
কক্সাবাজার জেলা ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ। ফেনীর সোনাগাজী, চট্টগ্রামের মিরসরাই-সীতাকুণ্ডের সমুদ্রপাড়ে ৩০ হাজার একর জায়গায় নির্মিত হচ্ছে দেশের বৃহৎ শিল্পনগর। পতেঙ্গায় নান্দনিক আউটার রিংরোড পার হতেই দেখা মিলবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।
আনেয়ারায় ৭৭৮ একর এলাকা জুড়ে 'চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন (সিইআইজেড) নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন। বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকায় স্থাপিত হয়েছে এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির যৌথ মালিকানাধীন ১,৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বন্দর, জ্বালানি, যোগাযোগ খাতের প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনীতিতে সুদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। একটি নতুন শিল্প করিডোর এশিয়ান হাইওয়ের সাথে যুক্ত হবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নতুন রেল কানেকটিভিটিও শিল্পের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।"
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শিল্প কারখানা গড়ে উঠার প্রধান কারণে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে শিল্প কারখানা স্থাপন ত্বরান্বিত হয়। বঙ্গবন্ধু টানেল এর বড় উদহারণ। এই সুড়ঙ্গ পথকে ঘিরে কর্ণফুলী এবং আনোয়ার উপজেলায় ইতোমধ্যে প্রায় ১০০টি কোম্পানি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ শুরু করছে। চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার ঘিরে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং পর্যটনকে উৎসাহিত করবে।
পোর্ট ইউজার্স ফোরামের চেয়ারম্যান এবং এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্ধারিত টাইমলাইনের মধ্যে শেষ না করার কোনো বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম এবং সমুদ্র উপকুলবর্তী অঞ্চল ঘিরে এখানে যে ফরেন ইনভেস্টমেন্টগুলো হবে, এর যে কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি হবে– এটির জন্য দক্ষ জনশক্তি দরকার। এজন্য প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।"
কক্সবাজার- চট্টগ্রামে উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পুরো চট্টগ্রামের সাথে রামগড়ের স্থলবন্দর হয়ে ভারত, মিয়ানমার হয়ে চীনের সাথে রেল লাইন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলের সাথে স্থলপথে ট্রানজিটের সম্ভাবনায় চট্টগ্রাম হয়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার বিজনেস হাব।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফারোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, "ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল বিনিয়োগকারীদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মাতারবাড়ি বন্দরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চলের অবকাঠামো সড়ক পথ, রেল পথ, সেইসাথে কর্ণফুলী টানেল পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চেহারাই বদলে দিতে শুরু করেছে।"