ইসিতে দুই চিঠি: নির্বাচন ঘনাতেই জাতীয় পার্টিতে ফিরেছে বিভক্তি
জাতীয় পার্টির কাছ থেকে দুটি চিঠি পেয়েছে নির্বাচন কমিশন—একটি দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ভাই জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে, অপরটি এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের স্বাক্ষর করা।
দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর চিঠিতে বলা হয়েছে, 'আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে আরওপিও অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে দলের প্রার্থী মনোনয়ন ও প্রতীক বরাদ্দ করবেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি।'
অন্যদিকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদে থাকা রওশন এরশানের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টি বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি হবে শুধু নির্বাচনী জোট। নির্বাচন শেষে জাতীয় পার্টির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসরণ করবেন।
রওশন 'বিরোধী দলের নেতা' হিসেবে তার চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। এ পদে তিনি বর্তমানে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
এদিকে চুন্নু তার চিঠিতে কোনো জোটের কথা উল্লেখ করেননি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ নিশ্চিত করেছেন, জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ইসি দুটি চিঠি পেয়েছে।
এ বিষয়ে ইসি সিদ্ধান্ত নেবে এবং সেই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে বলে জানান তিনি।
রওশন এরশাদের চিঠি উড়িয়ে দিয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা বলেছেন, তাদের দল আর কারও সাফল্যের পথের দালাল হিসেবে পরিচিত হতে চায় না।
আজ (১৮ নভেম্বর) দলের যৌথ কর্মী সভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, দল নিয়ে রওশন এরশাদের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই।
মোস্তাফিজুর বলেন, 'আমরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রস্তুত। এজন্য আন্দোলন অথবা নির্বাচন দুটোর প্রস্তুতি নিতে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে গড়ে ওঠা রংপুর অঞ্চলের ২২টি আসনে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এর আগে আজই জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, রাজনৈতিক আলোচনার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না থাকায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সে বিষয়ে আগামী দু-একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় পার্টি।
চুন্নু বলেন, 'আমাদের সিনিয়র নেতারা প্রয়োজনে আমাদের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের একটি সভা ডাকবেন। আমরা দু-এক দিনের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব যে আমরা নির্বাচনে যাব কি না।'
১৯৯১ সাল থেকে, বিশেষ করে ২০০১ সাল থেকে, নির্বাচনের আগে জোটের বিষয়ে বারবার অবস্থান বদলেছে জাতীয় পার্টি। এতে দলটির মধ্যে প্রায়ই বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি চারদলীয় জোট গঠনের জন্য বিএনপি ও জামায়াতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দলটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি ভাগ নিজেদের নাম দেয় জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)।
২০০১ সালে নাজিউর রহমান মঞ্জুর মূল জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি গঠন করেন।
নীতিগত পার্থক্যের কারণে এই বিচ্ছেদ ঘটে। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে জায়গা পায়, এমনকি অষ্টম জাতীয় সংসদে চারটি নির্বাচনী আসনও পায়।
জাতীয় পার্টিও ২০০৬ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই জোটে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন এরশাদ, যদিও পরে সেই সিদ্ধান্ত বদলান।
দলের নেতৃত্ব নিয়ে কাদের ও রওশনের মধ্যে চলমান বিভক্তির আগে ২০১৩ সালে কাজী জাফর আহমেদের (১৯৮৯-৯০ সালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) সঙ্গেও বিভক্তি সৃষ্টি হয়।
'বারবার অবস্থান বদলের জন্য' এরশাদকে অপসারণের নির্দেশ দেন জাতীয় পার্টির তখনকার প্রেসিডিয়াম সদস্য জাফর।
এর আগে জাফরকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন এরশাদ।
২৩ নভেম্বর কাজী জাফর নির্বাচনকালীন সরকারে যোগদানের জন্য এরশাদকে নিন্দা জানিয়ে বলেছিলেন, পার্টির চেয়ারম্যান 'জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন'।
২০১৪ সালে ফের এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি আবারও নির্বাচনে যোগদানের বিষয়ে দলটির অবস্থান বদল নিয়ে দীর্ঘ নাটকীয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
একপর্যায়ে গোয়েন্দা বাহিনী তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যায় বলে খবর প্রকাশিত হয়।
একই দিনে এরশাদ একটি 'অলৌকিকভাবে সেরে ওঠেন' এবং তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ এনভয় করে তাকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়।
এরপর জাতীয় পার্টি ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়।
ওই নির্বাচনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তার দলের নেতারা 'উন্মুক্ত আসন' থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থীদের সমর্থন দেবে।