জাতীয় পার্টির দ্বন্দ্ব আরো ঘনীভূত হলো!
বরাবরের মতো প্রতিটি নির্বাচনে আলোচনায় থাকা জাতীয় পার্টিতে (জাপা) এবারও নির্বাচনের আগে দেখা দিয়েছে নাটকীয়তা। দলটির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিরোধ আরও গভীর হচ্ছে। সোমবার (২৭ নভেম্বর) জাতীয় পার্টি আসন্ন নির্বাচনে রওশন এরশাদপন্থীদের বাদ রেখে প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করায় দলটিতে এ দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
দলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রওশনপন্থীদের দলে না ভিড়িয়ে নিজেদের মতো করে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করেছেন পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। এমনকি প্রয়াত এরশাদের আসনেই মনোনয়ন পেয়েছেন জিএম কাদের। শুধু রওশন এরশাদের জন্য ময়মনসিংহ-৪ আসনটি ফাঁকা রাখা হয়েছে।
রংপুর-১ আসনে মশিউর রহমান রাঙ্গার জায়গায় মনোনয়ন পেয়েছেন এইচ এম শাহরিয়ার আসিফ, রংপুর-৩ আসনে এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং পিরোজপুর-৩ আসনে রুস্তম আলীর জায়গায় মনোনয়ন পেয়েছেন মো. মাশরেকুল আজম রবি।
দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের রংপুর-১-এর পাশাপাশি ঢাকা-১৭ আসনে এবং তার স্ত্রী শরীফা কাদের ঢাকা-১৮ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। এদিকে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মুজিবুল হক চুন্নু।
রওশনপন্থী নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ সোমবার রাতে বলেন, 'আজ আমাদের জন্য খুব দুঃখের দিন। এটা আমরা আশা করিনি। জাপা এর আগেও চারবার ভেঙেছে। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই জাতীয় পার্টিতে ভাঙন দেখা দেয়। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। রওশন এরশাদ আমাকে সোমবার বিকালেও জানিয়েছেন, তোমরা চিন্তা কোরো না, যা করি একসঙ্গেই থাকবো। যখন শুনলাম বিকালে জি ম কাদের একতরফাভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন, এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। পার্টি পাঁচবারের মতো ভেঙেছে বলতে পারেন।'
গোলাম মসীহ এর আগে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছিলেন, 'আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের অপেক্ষায় আছি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় বসলেই একটি সমাধানে আসা যাবে।'
জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতার সাথে কথা হলে তারা টিবিএসকে জানান, জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যকার দ্বন্দ সমাধানে বেশ কয়েকবার তাদের মধ্যে মিটিং হয়েছে। কিন্তু জিএম কাদের রওশন এরশাদপন্থী নেতাদের ছাড় দিতে রাজি নন। মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ বহিষ্কৃত কাউকেই দলে ফেরাতে রাজি হননি জিএম কাদের। ফলে দলটি কোনো সমাধানেও আসতে পারেনি।
অপরদিকে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ প্রধামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। ফলে এক সপ্তাহের বেশি সময় ঘুরেও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি রওশন এরশাদ— এমনটাই জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতা।
গোলাম মসীহ বলেন, 'এবার রওশন এরশাদকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের কারণে পার্টিতে যে ভাঙন ধরানো হলো, আমি জানি না কী অবস্থা হবে। এর আগে জাপা চারবার ভেঙেছে। এরশাদ ও রওশনের নেতৃত্বে পার্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াব। ভাঙনের দায়ভার জি এম কাদেরকে নিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ইতিহাস তার বিচার করবে, জাপা নেতারা তার বিচার করবেন। রওশন এরশাদের সঙ্গে বসে আমরা করণীয় ঠিক করবো। এই পরিস্থিতিতে, এই ভাঙনের অবস্থায় তিনি (রওশন এরশাদ) নির্বাচনে যাবেন না। যতদিন পর্যন্ত এই বিষয়টির মীমাংসা না হবে, উনি নির্বাচনে যাবেন না। জিএম কাদের ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। বেগম রওশন এরশাদ নৌকা বা অন্য কোনো প্রতীকে ভোট করবেন না।'
ভোটে অংশগ্রহণ নিয়ে নির্বাচনের আগে বরাবরই নাটকীয়তা দেখা যায় জাতীয় পার্টিতে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচন ছাড়া আগের সব নির্বাচনেই দলটিতে এই নাটকীয়তা দেখা গেছে। দলটি সাধারণত নির্বাচনের আগে ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে মত বদলে ফেলে।
১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি এখন পাঁচটি গ্রুপে বিভক্ত। জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে আবার বিভাজন হলে ছয়টি দৃশ্যমান গ্রুপ তৈরি হবে।
এখন জাতীয় পার্টির নামে ৪টি নিবন্ধিত দল রয়েছে। এগুলো হলো: জাতীয় পার্টি-জাপা (জিএম কাদের), জাতীয় পার্টি-জেপি (মঞ্জু), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন) এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (পার্থ)। বাকি গ্রুপগুলো হলো কাজী জাফর গ্রুপ এবং নতুন রওশন এরশাদ গ্রুপ।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠার পর থেকে মূল দলের নেতৃত্বে ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ প্রধান দলের প্রতীক ছিল 'লাঙল'। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ দল পাল্টে বিএনপিতে, আবার কেউ কেউ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ এবং ২০১৩ সালে আরও দুটি উপদল সৃষ্টি হয় দলটিতে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে চারদলীয় জোটের বিপরীতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মিলে একটি মহাজোট গঠন করে।