অপরিশোধিত ভর্তুকি, ডলার সংকট পিছু ছাড়ছে না বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অপরিশোধিত তেল এবং গ্যাসের বাজারের অস্থিরতার ফলে দেশের জ্বালানি খাতে সামগ্রিক অর্থ পরিশোধের ঘাটতি আগেই সৃষ্টি হয়েছিল। তবে গত দেড় বছরে এ ঘাটতি আরও গুরুতর হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এনার্জি সংস্থাগুলো স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছে কয়েক হাজার কোটি টাকার এবং আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস সরবরাহকারীদের কাছে ডলারের বড় অঙ্কের দেনার মুখে পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাঠানো জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের চিঠি অনুসারে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎ ভর্তুকির বকেয়া টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকায়। ফলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা)-এর জন্য সমস্যাটি একটু ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ করতে হিমশিম এ দুটি সংস্থা।
এছাড়া প্রাপ্ত সর্বশেষ উপাত্ত অনুযায়ী, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের বিদেশি এবং স্থানীয় সরবরাহকারীদের কাছে পেট্রোবাংলা এবং বিপিসির দেনা প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার।
পিডিবি গ্রাহকদের কাছে ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। ঘাটতি থাকা এ অর্থ সরকার থেকে পাওয়া ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করা হয়।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ধেকের উৎস জ্বালানি তেল এবং তরল গ্যাসের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছরে বিদ্যুতের ভর্তুকি বেড়ে হয়েছিল ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এখনো ছাড় দেওয়া হয়নি। এদিকে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে নতুন ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের অর্থ পরিশোধে সহায়তা করার জন্য জ্বালানি বিভাগ অর্থ বিভাগকে বকেয়া ভর্তুকি ছাড় দিতে অনুরোধ করেছে।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা)-এর সভাপতি ফয়সাল খান বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের বকেয়া ২৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
'সরকার বিপুল এই বকেয়া পরিশোধের জন্য বিভিন্ন সমাধান নিয়ে কাজ করছে। বড় অঙ্কের এ বকেয়ার কারণে স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদকেরা (আইপিপি) সমস্যায় পড়েছে। স্থানীয় ব্যাঙ্কগুলোর তাদের তারল্য ঘাটতির কারণে আইপিপিগুলোকে সহায়তা করতে পারছে না। আমরা সমাধানের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই,' ফয়সাল বলেন।
ক্রমাগত ডলার সংকট আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধ জটিল করে তুলেছে। ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসির বকেয়া দাঁড়িয়েছে ২৯৬ মিলিয়ন ডলারে। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বরে এসব পাওনা পরিশোধের কথা ছিল। জ্বালানি বিভাগ অক্টোবরে অর্থ বিভাগকে দেওয়া চিঠিতে জানিয়েছে, দুটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বকেয়া পরিশোধ না করলে আর জ্বালানি সরবরাহ করবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছে।
বিপিসি বলছে বাহ্যিক দায় পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে এটির ৫০০–৬০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, কিস্তু তার তুলনায় এটি অনেক কম অর্থ পায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বরের প্রথম ১২ দিনে বিপিসিকে মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।
রোববার ইউএনবি'র এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও পেমেন্ট সংকটের তীব্রতার কথা স্বীকার করেছেন।
'আসলে সংকট স্থানীয় মুদ্রার নয়। কোনোভাবে আমরা এটার ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু মূল সংকট হচ্ছে ডলার। আমরা আমাদের চাহিদামতো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছি না,' তিনি ইউএনবিকে বলেন।
তিনি আরও জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় পরিশোধের জন্য মাসে কমপক্ষে ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।
'কিন্তু আমরা এর অর্ধেকেরও কম পাচ্ছি। ফলে প্রতি মাসে ক্রমবর্ধমান বকেয়া বাড়ছে,' সংবাদ সংস্থাটিকে বলেন প্রতিমন্ত্রী।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক অবশ্য টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোকে তাদের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে।
পেট্রোবাংলার এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে এক হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা দেনা রয়েছে। আর শেভরনসহ বাংলাদেশে সক্রিয় বিদেশি গ্যাস কোম্পানিগুলোর কাছে এটির বকেয়া মোট এক হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। ডলারে প্রদেয় এলএনজি এবং গ্যাসের জন্য মোট বকেয়া বর্তমান বিনিময় হারে ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের সমান হবে।
এ মাসের শুরুতে মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত পরবর্তী বছরের জন্য নতুন জ্বালানি আমদানি করতে হলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এ দুই তেল ও গ্যাস সংস্থার আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে।
পিডিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, তারা ভর্তুকির অর্থ ছাড়ের জন্য অর্থ বিভাগের সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসেছেন।
'বিভাগ আশ্বস্ত করেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পুরো বকেয়া ভর্তুকি চলতি অর্থবছরে ছাড়া হবে। আগামী অর্থবছরে সরকার সম্পূর্ণ অর্থ সরবরাহের পরিকল্পনা করছে,' তিনি বলেন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। 'তবে আইএমএফের শর্তসহ বিভিন্ন কারণে সরকার বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে পারে বলে কথা হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভর্তুকি কমে গেলে সরকারের পক্ষে বকেয়া পরিশোধ করা সহজ হবে।'
বর্তমানে দেশে ৫৫টি সরকারি ও ৭৮টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। জ্বালানি কেনার টাকা না থাকায় এবং শীত মৌসুমের কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।
দেশে বিদ্যুতের চাহিদা এখন গড়ে আট হাজার ৫০০ মেগাওয়াট থেকে নয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মধ্যে। তবে সেচ মৌসুম শুরু হওয়ার পর জানুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এ চাহিদা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় চাহিদা মেটানো হচ্ছে এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সৌরবিদ্যুৎ ও আমদানি করা বিদ্যুৎ থেকে।
পিডিবিকে 'বাকিতে' ফার্নেস তেল সরবরাহ করে বিপিসি
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোও বকেয়ার সমস্যায় পড়েছে।
পিডিবির জন্য কেনা ফার্নেস তেলের দাম আদায় করতে পারছে না বিপিসি। শীতকালে বিদ্যুতের কম চাহিদার কারণে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন বিপিসির তেল ডিপোগুলি পিডিবির না নেওয়া ফার্নেস তেলে ভরে উঠেছে।
জ্বালানি বিভাগের নভেম্বরের সভার কার্যবিবরণী অনুসারে, চাহিদা-আদেশ জারি করা সত্ত্বেও পিডিবির নগদ সঙ্কট এটিকে বিপিসি থেকে ফার্নেস তেল কেনা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করছে।
ফলে, গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিপিসির কাছে এক লাখ ১৫ হাজার টন ফার্নেস তেলের মজুত সৃষ্টি হয়েছে যা স্বাভাবিক সময়ের চাহিদার হিসেবে ১২৫ দিনের চাহিদার সমান।
'এখন পিডিবিকে এক মাসের ফার্নেস তেল বাকিতে সরবরাহ করা হচ্ছে,' বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বর শেষে কোম্পানিটির কাছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা জমা ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় ডলার সংকট আমদানিকৃত জ্বালানির অর্থ পরিশোধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।