নতুন সরকারকে অর্থনীতিতে ‘শক থেরাপি’ দিতে হতে পারে: মোস্তাফিজুর রহমান
অর্থনীতিতে ভারসাম্য আনতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর, নতুন সরকারকে 'শক থেরাপি'র মতো উদ্যোগ নিতে হতে পারে বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
এই শক থেরাপি দেশের জনগণের জন্য 'পেইনফুল' হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে এটি প্রয়োজন এবং পেইনফুল হলেও আমাদের তা মেনে নিতে হবে।"
মঙ্গলবার অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত 'কনভারসেশন উইথ প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান' শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠানে তিনি শক থেরাপি বলতে মূলত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ও ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা, ব্যাংক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করার মতো উদ্যোগগুলোর কথা বলেন।
এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রাথমিকভাবে নিত্যপণ্যের মূল্যস্তর আরও বেড়ে যাবে। তবে এরপরে মূল্যস্ফীতির হার কমবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "মূল্যস্তর বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি কমলেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে থাকে। আর এই সমস্যা সমাধানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।"
তিনি বলেন, "বিনিময় হার এখন ক্রলিং পেগ করে ঠিক করা হচ্ছে। এভাবে নির্ধারিত হলে বাজারে ধারণা হয় যে, বিনিময় হার আরও বাড়বে। সুদহার ট্রেজারি বিলের সুদহারের সাথে সমন্বয় করে নির্ধারিত হচ্ছে। এই পদ্ধতি থেকেও সরে এসে বাজারের ওপর ছাড়া উচিত।"
তিনি বলেন, এসব উদ্যোগের ফলাফল হবে 'পেইনফুল' (কষ্টদায়ক)। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার অবনমন হবে। সঞ্চয়কারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে স্থিতিশীল অর্থনীতির স্বার্থে সবাইকে এটি মেনে নিতে হবে। নতুন অ্যাডজাস্টমেন্ট স্বীকার করে আয় ও ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, "শক থেরাপির ফলাফল শুধু পেইনফুল হবে তা নয়, কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাবও আসবে। বিনিময় হার বেড়ে বৈধ পথে রৈমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াবে। এতে রেমিট্যান্সে সরকার যে প্রণোদনা দিচ্ছে, সেটা নাও লাগতে পারে। আবার রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ফলে দুই বছরের মধ্যে অর্থনীতিতে একটি ভারসাম্য আসবে।"
দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ ঋণ নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। ওইসময় বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ছিলো ১:১, যা বর্তমানে ৮:১। এটি নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। এ অর্জনে বেসরকারি খাতের ভূমিকার পাশাপাশি সরকারের নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা বড় ধরনের সহায়তা করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথম প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ ছিল বাণিজ্য করার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা। তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র শ্রমমূল্য দিয়েই তৈরি পোশাক শিল্পের মতো খাতে বড় বাণিজ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে। প্রথম প্রজন্ম সফলভাবে তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে।
এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এলডিসি থেকে উত্তরনের পর যে ট্যারিফ চ্যালেঞ্জ আসবে সেটি।
"এছাড়া শোভন কর্মসংস্থান, এনভায়রনমেন্টাল কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা– এজন্য দরকার সক্ষমতা বাড়ানো। অবশ্যই রপ্তানিতে বৈচিত্র দরকার। সেই বৈচিত্র তৈরি পোশাক শিল্পের মধ্যে এবং তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে করতে হবে। তৈরি পোশাক খাতে অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। কারণ তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক বাজার ৭০০ বিলিয়ন ডলার, যার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের," বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, চামড়া ও ওষুধ শিল্পের বৈশ্বিক বাজার প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার করে। এই বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়ানোর সুযোগ আছে। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশে ডমেস্টিক ট্যারিফ এরিয়াতে এফডিআই নিরুৎসাহিত করা হয়। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এপিআই পার্ক ও ট্যানারি শিল্প পার্ক স্থাপনে বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও এক দশক ধরে ১০০-১৫০ কোটি টাকা খরচ করে। সেখানে কেন ইটিপি স্থাপন করা হচ্ছে না, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
"এপিআই ও ট্যানারি শিল্প পার্কে ইটিপি স্থাপন হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। বিদেশি বিনিয়োগ আসলে এসবখাতের যেসব প্রভাবশালী শিল্পমালিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তারাই ইটিপি হতে দিচ্ছে না। এর পেছনে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয় রয়েছে," বলেন তিনি।
সুবর্ণ সুযোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ
বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের কারণে অর্থনীতির জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি কাজে লাগাতে ট্রান্সপোর্ট করিডোরগুলোকে ইকোনোমিক করিডোরে রূপান্তর করতে হবে। টোল দিয়ে এসব অবকাঠামোর মেইনটেনেন্স করা গেলেও বিনিয়োগ তোলা সম্ভব হবে না। বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পেতে ইকোনমিক জোনগুলোতে বিনিয়োগ হতে হবে। সেখান থেকে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসবে।
উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, "বর্তমানে এশিয়ান সেঞ্চুরি চললেও বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাত্র ১২ শতাংশ এশিয়াতে করছে। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া এবং আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে হবে। বিনিয়োগ, যোগাযোগ ও বাণিজ্যের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে হবে।
রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষের আস্থা ধরে রাখতে হলফনামায় উল্লেখিত সম্পদ ক্ষতিয়ে দেখা উচিত
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামায় দেখা যাচ্ছে সম্পদ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সরকার দলীয় এমপিসহ যাদের সম্পদ বেড়েছে, তাদের সম্পদ বৈধভাবে বেড়েছে কি-না, তা পার্টির এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত করা উচিত। এতে সাধারণ মানুষও পরিষ্কার ধারণা পাবে। নতুবা রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের আস্থা ধরে রাখা যাবে না।"
দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নেই
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় যে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নেই। তবে অনেক সময় পর্যাপ্ত উৎপাদন ও মজুদ সত্বেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। এজন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়িয়েছে।
"প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনেক তথ্য থাকে, যা আমার কাছে নেই। সেসব তথ্যের ভিত্তিতে তিনি কোনো মন্তব্য করতে পারেন। তবে আমার মনে হয়, দুর্ভিক্ষের কোনো আশঙ্কা নেই," জানান মোস্তাফিজুর রহমান।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অবস্থান সম্পর্কে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো বলেন, "বিভিন্ন দেশের সাথে আমাদের বাণিজ্য আছে, অনেক দেশ আমাদের ঋণ দেয়, ফলে তাদের চাপ থাকতে পারে। তবে সেটা ততটুকু গুরুত্ব দেবো, যতটুকু আমাদের প্রয়োজন।"
বিদেশি চাপ মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণকে নিয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি।
সিপিডি সম্পর্কে মন্ত্রীদের বক্তব্য দুঃখজনক
ব্যাংক খাতের অনিয়ম, আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের সড়ক ও সেতু মন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তাকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
২৪ ডিসেম্বর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সিপিডি জানায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত বড় ২৪টি বড় অনিয়ম/কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ব্যাংকখাত থেকে যে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, তার পরিমাণ ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
পরে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, "ব্যাংক খাতে আর্থিক অনিয়মের যে অভিযোগ সিপিডি তুলেছে, সেটি তাদেরই খণ্ডাতে হবে। সিপিডিকেই বলতে হবে, টাকাগুলো কোথায় আছে। তারা বিস্তারিত তথ্য দিলে, আমরা সেই টাকা দেশে ফিরিয়ে আনব।"
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, "সিপিডি কোনো গবেষণা করেনি। কিছু পত্রিকার কাটিং জোগাড় করে একটা রিপোর্ট তৈরি করে সেই আলোকে সংবাদ সম্মেলন করেছে। তাদের বক্তব্য নির্জলা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।"
এ প্রসঙ্গে সিপিডির অবস্থান জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "লক্ষ করা যাচ্ছে কোনো সমস্যা নিয়ে কে বলেছে, কেনো বলেছে– এসব দেখা হচ্ছে। কী বলছে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। যেভাবে রিঅ্যাকশন দেখানো হচ্ছে সেটি খুবই দুঃখজনক।"
তিনি বলেন, সিপিডি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। যেসব রিপোর্টে কোনো ধরনের প্রতিবাদ আসেনি।
তিনি বলেন, "সমস্যা যখন হয়, তখন সেটিকে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা হিসেবে না দেখে সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। অস্বীকার করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।"
"আমাদের ধারণা ছিল, নির্বাচনের আগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের হলফনামায় এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে অঙ্গীকার করবেন। কিন্তু কে বলেছে, কী উদ্দেশ্যে বলেছে– এগুলো নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। কী বলেছে, সেটি সত্য কি-না বা কতটুকু সত্য, সমস্যা সমাধানে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সে সম্পর্কে তারা কিছু বলছেন না," যোগ করেন তিনি।
ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।