কেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন জাতীয় পার্টি, বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা?
আসন্ন ৭ তারিখের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিরোধী দলে থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা করা তিনটি দল জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম), তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। আবার কোনও কোনও প্রার্থী সরে না দাড়ালেও নির্বাচনী মাঠে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এখন পর্যন্ত এ তিনটি দলের অন্তত ৩০ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
নির্বাচন ত্যাগ করা এসব প্রার্থীর অভিযোগ দলের শীর্ষ নেতারা তাদের খোজঁ-খবর নিচ্ছে না, দলীয় ফান্ড থেকে তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া সুষ্ঠ নির্বাচনের পরিবেশ না থাকা ও আসন ভাগাভগির কারণে সমঝোতার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
তবে দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলছেন, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর স্বাধীনতা প্রার্থীদের রয়েছে। প্রার্থীদের আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকার কারণে অনেকে নিষ্ক্রিয় কিংবা সরে দাঁড়াচ্ছেন বলে দাবি তাদের।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, "মিডিয়ার সামনে আমাদের দোষ দিয়ে যারা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন তা দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা নিজেদের স্বার্থে সরে যাচ্ছেন। দলের সবার আর্থিক অবস্থা সমান নয়। এ কারণে কেউ কেউ প্রচারণায় নেই, আবার কেউ সরেও দাঁড়াচ্ছেন। তবে তা খুব বেশি নয়।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টির ২৬টি আসনে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্তের কারণে বাকি আসনগুলোর প্রার্থীদের মধ্যে 'অবহেলিত' মনোভাব তৈরি হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রের সাথে তৃণমূলের এক ধরণের দূরত্ব তৈরি হয়েছে যা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সাংগঠনিক শক্তির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।
জাতীয় পার্টিরই অন্তত ২৫ প্রার্থী সরে দাঁড়ালেন
এবারের নির্বাচনে ২৬৫ টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। তবে পরবর্তীতে দলটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে কয়েক ধাপে মিটিং করে ২৬ টি আসনে সমঝোতা করে।
এ নিয়ে শুরু থেকেই দলের তৃণমূল নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। ফলে বুধবার পর্যন্ত জাতীয় পার্টির প্রায় ২৫ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীদের অনেকেই বলছেন, শুরু থেকেই জাতীয় পার্টির 'সমঝোতার' মাধ্যমে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন তারা। তারা বলছেন, সারা দেশে ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেয়ার সক্ষমতা থাকার পরও কেন্দ্রীয়ভাবে ২৬টি আসনের সমঝোতা করে নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টির জন্য 'ভুল' ছিল।
গতকাল (বুধবার) সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টির চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সোহরাব হোসেন ও চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের রবিউল ইসলাম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
এমনকি জাপা চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদকের অবমাননাকর আচরণের অভিযোগ করেছেন সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, "অর্থনৈতিক দুরাবস্থার ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অসহযোগিতার কারণে বাধ্য হয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালাম।"
সিলেট-৫ আসনের জাপা প্রার্থী সাব্বির আহমেদও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকা এবং 'চাপ'-কে কারণ হিসেবে দেখিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
সাব্বির আহমেদ বলেন, "সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি মাঠে কোথাও দেখা যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই এবং এ অবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অসম্ভব।"
একই দিনে পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকার অভিযোগ এনে গাইবান্ধা-৫ আসনের প্রার্থী আতাউর রহমান আতা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
গত মঙ্গলবার টাঙ্গাইল-৭, দিনাজপুর-২, গাজীপুর-৪ ও সুনামগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
এর আগে সোমবার (১ জানুয়ারি) হবিগঞ্জ-২ আসনের জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন।
গত ৩১ ডিসেম্বর বরিশাল-২, বরিশাল-৫, বরগুনা-১ ও গাজীপুর- ১ আসনের প্রার্থীরাও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
গত রবিবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন গাজীপুরে দুটি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন। তিনি জাতীয় পার্টির গাজীপুর মহানগরের সভাপতিও।
নিয়াজ উদ্দিন বলেন, "সরকারের একতরফা নির্বাচন, সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যক্তিগত কারণে সরে দাঁড়িয়েছি। আমার সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও কোনো আলোচনা হয়নি।"
ঢাকা-১৩ ও ১৪ আসনে প্রার্থী হলেও পরে প্রত্যাহার করে নেওয়া জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, "জিএম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বেঈমানি করেছেন। তারা ব্যক্তিগত লাভের জন্য দলকে ধ্বংস করেছে। তারা সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে নির্বাচন করছে। এখন আর তারা কারো খোঁজ নিচ্ছে না।"
'নেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড'
বিএনপির সাবেক এমপিদের দলে নিয়ে নির্বাচনে চমক দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম)। তবে তাতে ব্যর্থ হয়ে শেষমেষ ৫৬ টি আসনে প্রার্থী দিলেও ভোটের মাঠের লড়াইয়ে ৫ জন প্রার্থীও নেই। ইতিমধ্যে নির্বাচন থেকে সরে দাড়িয়েছেন কেউ কেউ।
গত মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ-৪ আসনের বিএনএম মনোনীত প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান শামছুল আবেদীন নির্বাচনী মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, "আমি নির্বাচনে দাঁড়ানোর পর থেকেই আমার বিরুদ্ধে নানা রকমের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। প্রথমে আমার মনোনয়ন বাতিল করা হয়। পরে নির্বাচন কমিশন থেকে আমাকে নির্বাচন সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানে যা দেখছি সেখানে বলতে হচ্ছে, দেশে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটাই নেই।"
বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ফরিদপুর-১ আসনের প্রার্থী। তিনি এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। প্রতিদিনই প্রচারে নামছেন তিনি। দলটির মহাসচিব মো. শাহ্জাহানও চাঁদপুর-৪ আসনে নিয়মিত প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে দলের বাকি প্রার্থীদের আসনগুলোতে কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
'কেন্দ্র থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে না'
এদিকে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী সিলেট-৬ ও মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহীনুর পাশা চৌধুরী নিজেদের নির্বাচনী প্রচার বেশ জোরালোভাবেই চালাচ্ছেন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদা মুন্সিগঞ্জ-১ আসনেও প্রচারণা চালাচ্ছেন।
তবে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী দেওয়া ১৩৫ টি আসনের মধ্যে বাকি আসনগুলোতে প্রার্থীদের তেমন প্রচারণা নেই। প্রার্থী হলেও প্রচারে না থাকার বিষয়ে নিজেদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা।
প্রার্থীদের অভিযোগ, দল থেকেও তাদের সেভাবে কোনো খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচনী ব্যয় পরিচালনার জন্য দল থেকে কোনো ধরণের আর্থিক সহায়তাও তারা পাচ্ছেন না।