আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলের প্রার্থীরা ‘আশঙ্কা’ নিয়েই ভোটের মাঠে
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া স্বতন্ত্র ও বেশ কয়েকটি দলের প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের কাছ থেকে হুমকি-ধমকি ও নির্বাচনে 'কারচুপির আশঙ্কা' নিয়েই মাঠে রয়েছেন। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাই যত বাধাই আসুক শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবেন তারা।
এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া ২৭টি ছোট রাজনৈতিক দলের এক হাজার ৫৩৪ জন এবং স্বতন্ত্র ৪৩৬ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন।
জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম), তৃণমূল বিএনপিসহ অন্যান্য ছোট দলগুলোর প্রার্থীদের অভিযোগ- নানা ধরনের বাধা উপেক্ষা করেও দলগুলোর নেতারা এখন পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে আছেন। তাদের মনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না সেটা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
এদিকে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের থেকে হুমকি পাচ্ছেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এমন অন্তত ১০০ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) যশোর-৫ আসনের জাতীয় পার্টি ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
শুক্রবার তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নির্বাচনে আমাদের প্রার্থীদের ওপর বিভিন্ন স্থানে হুমকি-ধমকি আসছে। আমরা মাটি কামড়ে হলেও নির্বাচনের মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকব। যদি কোথাও কারচুপি হয় তবে সারা দেশে তুফান লাগিয়ে দিব।'
তিনি বলেন, 'নির্বাচনের মাঠে এখন গুন্ডা, অস্ত্রধারীদের কোনো দাম নেই যদি প্রশাসন সহযোগিতা না করে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা দিয়েছেন সুষ্ঠু নির্বাচনের। তাই জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য আমরা হুমকি-ধমকির মধ্যেও এখনও নির্বাচনের মাঠে আছি।'
তিনি আরো বলেন, 'এ সরকারের আমলে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ নানা মেগা প্রকল্প ম্লান হয়ে গেছে কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণে। এখন নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী যদি মাঠের পুলিশ, বিজিবি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কাজ না করে তবে আমি বিশ্বকে ঘুরে ঘুরে সে কথা জানাব।'
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, 'দেশে এখনও চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভোট সুষ্ঠু না হলে সংসদ নির্বাচনের পর অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে।'
নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও অস্থিরতা পুরোপুরি কমবে না বলেও মনে করেন তিনি।
বিএনএম এর মহাসচিব মো. শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্যাম্প পুড়িয়ে দেওয়াসহ প্রতি মুহূর্তেই হুমকি-ধমকির খবর পাচ্ছি। এখন পর্যন্ত আমরা মনস্তাত্ত্বিক চাপে আছি। আমরা ভোটের শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই। ভোটের দিন কারচুপির ঘটনা ঘটলে আমরা তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিব।'
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের টাকার দৌরাত্ম্যের কারণে দেশের অনেক নির্বাচনী এলাকায় জাপার প্রার্থী নির্বাচন ছেড়ে দিচ্ছেন উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বৃহস্পতিবার সাবাদিকদের বলেন, 'প্রার্থীরা টাকার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। দলীয় কোনো ফান্ড না থাকায় আমরাও ফান্ড দিতে পারছি না।'
তিনি বলেন, 'আমার নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনেও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লাখ লাখ কোটি টাকা ছিটিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি। ইসি আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে টাকার দৌরাত্ম্য হবে না। নির্বাচন খুব ভালোভাবে হবে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হবে না।'
ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই এমন অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী রাকিব হোসেন।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, 'সারাদেশে প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরের সাধারণ মানুষ নির্বাচন বিমুখ হয়ে পড়েছে। বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু লোক নির্বাচনের মাঠ গরম রেখেছে।'
এছাড়াও রাকিব হোসেন অভিযোগ করে বলেন, 'নির্বাচনে কালো টাকার ব্যাপক ছড়াছড়ি হচ্ছে। কালো টাকার প্রভাবে কেন্দ্রে এখন এজেন্ট দেয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় আমার পোস্টার ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।'
এসব বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা কাছে অভিযোগ জানিয়েও তিনি কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানান জাপার এই প্রার্থী।
শুক্রবার যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের তৃণমূল বিএনপি প্রার্থী মেজর (অব.) আ. ন. ম. মোস্তফা বনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'দেশের বিরাজমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা কতটুকু সমীচীন হবে, একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে সে বিষয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। দেরিতে হলেও এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছি।'
গত বুধবার নোয়াখালী -৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন শাহীন সংবাদ সম্মেলন করে তার নেতা-কর্মীদের ওপর অব্যাহত হামলার অভিযোগ করেন। তিনি বাড়ি-ঘরে হামলারও অভিযোগ করেন। আর এই অভিযোগ নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
গত মঙ্গলবার রাতে গাইবন্ধা-৩ (পলাশবাড়ি-সাদুল্লাপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মফিজুল হক সরকারের কর্মীদের ওপর হামলা হয়। পুলিশকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
শরীয়তপুর-২ (নড়িয়া-সখিপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. খালিদ শওকত আলীর নির্বাচনী মিছিলে বোমা হামলা হয় গত ৩১ ডিসেম্বর। ওই আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা মার্কার এনামুল হক শামী৷ তিনি একজন উপমন্ত্রী।
নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রায় ৬০০টি অভিযোগ পেয়েছে। তার মধ্যে ৭০ ভাগের বেশি অভিযোগই নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। যার মধ্যে প্রায় ৪০০ অভিযোগ তারা আমলে নিয়েছে।
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরাও কোথাও কোথাও নৌকার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়েছেন বলে শোনা গেছে। আবার কোনো কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে টাকা ছড়ানোর অভিযোগও উঠেছে।
ফরিদপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের বিরুদ্ধে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ নৌকার প্রার্থী শামীম হকের। আর শামীম হকের সমর্থকদের বিরুদ্ধে অব্যাহত হামলার অভিযোগ স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের।