বাড়বকুণ্ড অগ্নিকুণ্ড: যুগ যুগ ধরে স্বচ্ছ পানির ওপর জ্বলছে যে আগুন
সাধারণত আগুন নেভাতে পানি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু সেই পানির ওপরই জ্বলছে আগুন। তা-ও আবার যুগ যুগ ধরে। বিষয়টি অবাক করার মতো হলেও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডের একটি পাহাড়ের চূড়ায় বিরল এই দৃশ্যের দেখা মেলে।
স্থানীয়দের কাছে এটি বাড়বকুণ্ড অগ্নিকুণ্ড নামে পরিচিত। স্বচ্ছ পানির ওপর জ্বলতে থাকা এই অগ্নিশিখা পর্যটকদের কাছে অন্যতম একটি আকর্ষণ।
স্থানটি কেবল ধর্মীয় দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা পৌরাণিক কাহিনি আর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মনোমুগ্ধকর সব গল্প।
মনে করা হয়ে থাকে, কয়েক শ বছর আগে দেবতাদের তুষ্ট করতে ধর্মীয় আচার বা রীতি অনুযায়ী মানুষকে বলি দেওয়া হতো। আর তখন থেকেই এই অগ্নিশিখাটি জ্বলছে। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এটিকে আশীর্বাদ বলে মনে করেন।
অগ্নিকুণ্ড ছাড়াও এখানে রয়েছে কয়েকটি মন্দির। রয়েছে প্রাচীন আরও দুটি শিব মূর্তি।
অগ্নিকুণ্ডটির ব্যাপারে একটি পৌরাণিক কাহিনি শোনালেন মন্দিরগুলোর তত্ত্বাবধায়ক স্মৃতি লতা ভারতী। তার মতে, ভগবান শিবের ক্রোধ প্রশমিত করতে ভগবান বিষ্ণু পার্বতীর দেহকে ৫১টি টুকরো করেছিলেন। তারই একটি টুকরো বাড়বকুণ্ডে পড়েছিল। সেই থেকেই এখানে পানির ওপর আগুন জ্বলছে।
যদিও এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক নানা দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে এই পাহাড়ের নিচে মিথেন গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয়। মনে করা হয়ে থাকে সেই গ্যাসই এই অগ্নিকুণ্ডের প্রকৃত উৎস।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি মাহবুব মোর্শেদের ব্যাখ্যা হলো- ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসা মিথেন গ্যাসের সঙ্গে বাতাসের বিক্রিয়ার ফলেই এভাবে আগুন জ্বলছে।
বাড়বকুণ্ড অগ্নিকুণ্ডকে ঘিরে রহস্য থাকা সত্ত্বেও সেখানকার গ্যাসের মজুদকে পরিত্যক্ত ও অনিষ্কাশনযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ঘটনাটি অলৌকিক নয়। এটি সীতাকুণ্ড অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা।
অনেকটা মাহবুব মোর্শের মতোই বললেন প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক মোকাম্মেল হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলছেন, মন্দিরগুলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করেন যে কূপের মাটির নিচে প্রাকৃতিক গ্যাস থাকার কারণে স্বচ্ছ পানির ওপর আগুন জ্বলছে।
পৌরাণিক কোনো কাহিনি হোক বা বৈজ্ঞানিক, বাড়বকুণ্ড অগ্নিকুণ্ড হাজার হাজার হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কাছে একটি আকর্ষণ, বিশেষ করে শুভ শিব চতুর্দশী তিথিতে।
ধর্মীয় তাৎপর্যের বাইরেও মনোরম পরিবেশ এবং নয়নাভিরাম পাহাড়ি দৃশ্যের কারণে স্থানটি পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এই প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গাটির যথাযথ সংরক্ষণ ও মন্দিরে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর হলে বাড়বকুণ্ড অগ্নিকুণ্ড হতে পারে চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।