রওশনের নেতৃত্বে নতুন জাতীয় পার্টি, ভবিষ্যৎ কী?
নানান নাটকীয়তা শেষে আবারও দৃশ্যমান ভাঙন ঘটলো জাতীয় পার্টিতে। জাতীয় পার্টির 'জাতীয় সম্মেলন' করে জিএম কাদেরের বাইরে গিয়ে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান এবং কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সমালোচনা করে বলেছেন, রওশন এরশাদ পন্থীরা পৃথক সম্মেলন করে দলের গঠনতন্ত্র বিরোধী কাজ করেছে।
"আরেকটি ব্রাকেটবন্দী দল হতে পারে। কিন্তু জিএম কাদেরের নেতৃত্বে আমরাই মূল জাতীয় পার্টি।"
তিনি আরও বলেন, "জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির সারাদেশের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ আছে। এইচ এম এরশাদের গড়া এই দল। এর নেতা-কর্মীরাও সেভাবে এই পার্টির প্রতি এক রয়েছেন।"
শনিবার (৯ মার্চ) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের বাইরে এক সম্মেলনের আয়োজন করেন রওশন এরশাদ পন্থীরা। এতে রাজধানী ও আশেপাশের এলাকার লোক সমাগম ছিল বেশি। জেলা পর্যায় থেকে নেতাকর্মীদের আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।
দলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরের কেউ আসেননি সম্মেলনে। উত্তরের জনপদ থেকে নামেমাত্র প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে জাতীয় পার্টির এক সিনিয়র নেতা (জিএম কাদের অংশ) টিবিএসকে বলেন, "জাতীয় পার্টির নেতারা নিজেদের স্বার্থে এক এক সময় ব্রাকেট বন্দি হয়ে যাচ্ছেন। এভাবে একটা সময় নির্বাচন থেকেও ছিটকে যেতে পারে এ পার্টি। সামনে হয়তো দেন-দরবারেও কোনো আসন মিলবে না জাতীয় পার্টির।"
কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। সম্মেলনের শুরুতে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান রওশন এরশাদ। পরে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে তার নামই প্রস্তাব করা হয় এবং উপস্থিত কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা দুহাত উঠিয়ে সমর্থন জানান।
এরপর দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর দলের অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের নাম ঘোষণা করেন।
মহাসচিব হিসেবে কাজী মামুনুর রশীদের নাম ঘোষণা করেন গোলাম সারোয়ার মিলন। তখন উপস্থিত সবাই তা সমর্থন করেন।
সম্মেলনে এরশাদের ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ ওরফে সাদ এরশাদকে দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান করা হয়। রওশনের অবর্তমানে সাদ দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন বলেও সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়।
দলের অন্যান্য পদের মধ্যে কাজী ফিরোজ রশিদ নির্বাহী চেয়ারম্যান, আবু হোসেন বাবলা সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, সাদ এরশাদ, গোলাম সরোয়ার ও সুনীল শুভরায়কে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে রওশন এরশাদ বলেন, "আজ যদি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হতো তাহলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেত। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত।"
তিনি বলেন, "দলে কোনো বিভেদ নেই। আমরা এক আছি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দল গোছাতে হবে।"
রওশন বলেন, "আমরা অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এখনও টিকে আছি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর যখন একটু ঘুরে দাঁড়ালাম– তখন আমাদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য আদালতে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল।
"মহামান্য আদালতের সুবিচারে পল্লীবন্ধু এরশাদ এবং আমি রওশন এরশাদ লাঙ্গল প্রতীক জাতীয় পার্টির জন্য বরাদ্দ পেয়েছিলাম। সেই লাঙ্গল প্রতীক এখনও আমাদের জাতীয় পার্টির অনুকূলে আছে এবং আগামীতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ," যোগ করেন রওশন।
পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে পার্টির ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না রেখে বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রস্তাব দেওয়ার কথা জানিয়ে রওশন বলেন, "জাতীয় পার্টিতে গণতন্ত্র চর্চার একটা নিদর্শন আমরা সৃষ্টি করতে চাই। সে লক্ষ্যে, আমাদের সম্মেলনের বাস্তবায়ন কমিটি কর্তৃক গঠিত গঠনতন্ত্র সংশোধন উপ-কমিটি গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব আনবে। আপনারা পাস করে দিলে তা জাতীয় পার্টির আইনে পরিণত হবে।"
সম্মেলনে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুর ইসলাম, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম এ মতিন ও বিএলডিপি চেয়ারম্যান এম নাজিম উদ্দীন আল আজাদ প্রমুখ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে নতুন করে বিভক্তি দেখা দেয়। দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে মতবিরোধে গত সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন নিজে এবার নির্বাচনে অংশ নেননি। তার অনুসারীদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি জাতীয় পার্টি।
নির্বাচনের পর পার্টি থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ কয়েকজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, যারা রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত। এরপর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে 'স্বেচ্ছাচারিতার' অভিযোগ এনে ৬৭১ জন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
সেই প্রেক্ষাপটে গত ২৮ জানুয়ারি এক মতবিনিময় সভায় রওশন নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে 'অব্যাহতি' দেন। তবে রওশনের ওই দাবি 'আমলে নেননি' জিএম কাদের বা চুন্নু।
এরমধ্যে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে জিএম কাদেরকে এবং উপনেতা হিসেবে কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে স্বীকৃতি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
এরপর গত ১০ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ৯ মার্চ দলের জাতীয় কাউন্সিল করার ঘোষণা দেন রওশন।
এখন রওশনের দলের প্রতীক কী হবে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন আবেদন নাকোচ করলেও আদালতের শরণাপন্ন হবেন তারা। লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টি নামে দল পরিচালনায় আইনি লড়াইয়ে সফল হতে চান রওশনপন্থীরা।