‘আমরা কিডন্যাপড হয়েছি, মুক্তি পাওয়ার আগে আর যোগাযোগ হবে না!’
নতুন বউকে নিয়ে বেড়াতে যেতেও পারেনি আলী হোসেন। তার আগেই জীবিকার তাগিদে ভেসেছিলেন ভারত মহাসাগরে এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজে চেপে। সর্বশেষ দুইদিন আগে স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়েছিল পরিবারের সাথে। কিন্তু মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিকেলে মুঠোফোনে মেসেজ পাঠিয়েছেন, 'আমরা কিডন্যাপড হয়েছি, মুক্তি পাওয়ার আগে আর যোগাযোগ হবে না!'
প্রথমে পরিবারের সদস্যরা কিছুই বুঝে উঠতে না পারছিলেন না, আসলে কী ঘটেছে। পরে টেলিভিশনের সংবাদে জানতে পারেন বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটির দখল নিয়েছে সোমালি জলদস্যুরা। এরপর থেকেই আলী হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে অনেকবার, কিন্তু তাঁকে ফোনে আর পাওয়া যায়নি।
দস্যুদের কবলে পড়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই সন্তানের জন্য বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন আলী হোসেনের মা নাসিমা পারভীন। কোনো সান্ত্বনা দিয়ে তাঁকে মানিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ডুকরে কাঁদছে আলী হোসেনের স্ত্রী ইয়ামনি। বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন পিতা ইমাম হোসেন মোল্লা।
এমন চিত্রই বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি ইউনিয়নের উপারের পাড় গ্রামে। খবর পেয়ে দলে দলে লোক এসে ভিড় করছেন ইমাম হোসেন মোল্লার বাড়িতে।
সংসারের ছোট ছেলে আলী হোসেন। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিয়ে করেছেন। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী আলী হোসেন বিজ্ঞান বিভাগে ২০১৪ সালে জিপিএ ৫ পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপরে ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জের মেরিন একাডেমিতে। সেখানে ৪ বছর পড়ালেখা শেষে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ২০২০ সালে চাকরিতে যোগ দেন। সবশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে কেএসআরএম শিপিং লিমিটেডের জাহাজে যোগ দেন দক্ষিণ কোরিয়ায়।
পিতা ইমাম হোসেন মোল্লা বলেন, 'আমরা অজানা আতঙ্কে রয়েছি। আলী হোসেনকে আমরা ফেরত চাই। আমার বুকের মানিককে আমি অক্ষত অবস্থায় ফেরত চাই।'
আলী হোসেনের মা নাসিমা পারভীন বলেন, 'আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার কলিজার টুকরা কোথায় কারা নিয়া গেছে। আমি পোলার লগে কথা কইতে পারতেছি না। আমার ছেলেকে সরকার ফেরত এনে দিক। আমার আর কোন চাওয়া-পাওয়া নাই। আলী হোসেনরে ছাড়া আমি বাঁচব না।'
স্বজনরা জানান, পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলায় তিনমাস আগে বিয়ে করেন আলী হোসেন। তাঁর স্ত্রী এইচএসসি পাস করে বর্তমানে মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রয়েছেন বাপের বাড়িতেই। দুইদিন আগে মুঠোফোনে স্ত্রী ইয়ামনিকে আলী হোসেন জানান, সামনের কুরবানি ঈদে এসে তাঁকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু এসবই এখন অনিশ্চিত।
বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অন্তরা হালদার বলেন, 'জাহাজে থাকা বিশারকান্দি ইউনিয়নের আলী হোসেনের নামটি আমরা অনেক চেষ্টায় পেয়েছি। ওদের পরিবারের সাথে আমরা এখনো যোগাযোগ করতে পারিনি। তবে দ্রুতই যোগাযোগ করব।'
বিশারকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে আমি আলী হোসেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মানসিক দিক দিয়ে পরিবারটি ভেঙে পড়েছে। ওদের পরিবারে সবচেয়ে ভালো চাকরি পেয়েছিল এই আলী হোসেন। সে এখন অপহরণ হয়ে যাওয়ায় পরিবারটি দিশেহারা হয়ে গেছে। যদিও আমি আশ্বস্ত করে এসছি। সান্ত্বনা দিয়ে এসেছি। আমরা চাই সরকারের চেষ্টায় দ্রুত সময়ে আলী হোসেনসহ জিম্মি হওয়া জাহাজটি পুনরুদ্ধার করা হোক। সরকারের কাছে এটাই আমাদের দাবি।
প্রসঙ্গত, গতকাল মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় দুপুরে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। এ সময় শিল্পগ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে নেয় সোমালিয়ান দস্যুরা। এদিন বিকেলে জাহাজটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। জাহাজে ২৩ জন নাবিক রয়েছেন।