গরমের শুরুতেই চট্টগ্রাম শহরে পানির জন্য হাহাকার
গ্রীষ্ম শুরু হতেই চট্টগ্রামে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে মাহে রমজানেও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নগরীর বাসিন্দারা।
চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও সুয়্যারেজ কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত কারণে নদীর পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছে, এতে সংস্থাটি সুপেয় পানি উৎপাদন করতে হিমশিম খাচ্ছে। চলতি মাসের শুরু থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা মোট উৎপাদনের অন্তত ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ কমিয়েছে, এতে সুপেয় পানির ঘাটতি তৈরি হয়েছে প্রায় ৮ - ৯ কোটি লিটার।
ওয়াসার সুপেয় পানি উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার থেকে প্রায় ৪১-৪২ লিটারে নেমে আসায়— বন্দর নগরীর পতেঙ্গা, কাঠগড়, ইপিজেড, হালিশহর, পাহাড়তলী, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সাধারণত আমরা কর্ণফুলী ও হালদা নদী থেকে পানি সংগ্রহ করি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততার হার অস্বাভাবিক বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় ২৫০ মিলিগ্রাম লবণাক্ততার হার পর্যন্ত পানি সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু, এবার জোয়ারের সময় তা বেড়ে ৩৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত হয়েছে, যা পরিশোধনের উপযুক্ত নয়। এজন্য হালদা নদী থেকে ৮-৯ ঘণ্টা পানি সংগ্রহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এছাড়া পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কর্ণফুলী নদীর স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেখান থেকে এক ঘণ্টা পানি সংগ্রহ করা যাচ্ছে না।"
"এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৫৪টি গভীর নলকূপ চালু করা হয়েছে। সেখান থেকে এক থেকে দেড় কোটি লিটার পানি অতিরিক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাকিটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। রেশনিং করে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে"- জানান তিনি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার বর্তমান আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। এরমধ্যে প্রায় ১০ হাজার গ্রাহক 'লাইন চার্জ' দিয়েও নিয়মিত পানি পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে, নগরীর ৪০ শতাংশ মানুষের কাছে এখনো ওয়াসার পানি পৌঁছেনি।
চট্টগ্রামের নিউমুরিং এলাকার বাসিন্দা রাফি হাসান টিবিএসকে বলেন, "আগে সপ্তাহে দুই দিন ওয়াসার পানি পেতাম। কিন্তু, এই মাসে শুধু একবার পেয়েছি। পানির জন্য আমাদেরকে গভীর নলকূপের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।"
চট্টগ্রাম ওয়াসার বোর্ড সদস্য ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর আফরোজা কালাম টিবিএসকে বলেন, "কিছু এলাকায় থেকে পানি না পাওয়ার অভিযোগ আছে। আবার কিছু এলাকায় লবণাক্ত পানির অভিযোগ আছে। বিষয়টি আমি ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, বন্দরনগরীতে সুপেয় পানির চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ৫ কোটি লিটার করে বাড়ছে। দৈনিক পানির চাহিদা ২০৩২ সাল নাগাদ ৬৩ কোটি লিটার, এবং ২০৪২ সালে ১২২ কোটি লিটারে পৌঁছাবে।
সংস্থাটি বর্তমানে চারটি শোধনাগারের জন্য অপরিশোধিত পানি সংগ্রহ করে তিনটি ইনটেক স্টেশন থেকে। ইনটেক স্টেশন এমন একটি অবকাঠামো যা নদী বা হ্রদের মতো উৎস থেকে পানি তুলে নিয়ে তা পানি শোধনাগার বা বিতরণ ব্যবস্থায় পৌঁছে দেয়।
এরমধ্যে রাঙ্গুনিয়ার ইনটেক স্টেশনের সক্ষমতা দৈনিক ৩০ কোটি লিটার, মোহরা ও মদুনাঘাটের ইনটেক স্টেশনের সক্ষমতা ৯ কোটি লিটার করে। এছাড়া বোয়ালখালীতে চলমান ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে দৈনিক ৬.৬ কোটি লিটার সক্ষমতার ইনটেক স্টেশন নির্মাণাধীন। এটি চলতি বছর জুনে চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
বছরজুড়েই সংকট
১৯৯৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম নগরবাসী প্রায় প্রতি বছরই লবণাক্ততার সমস্যায় ভুগছেন। শুষ্ক মৌসুমে যখন নদী উজান থেকে পর্যাপ্ত পানি পায় না, তখন বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানি এসে সেই জায়গা পূরণ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণমিশ্রিত জোয়ারের পানি হালদা নদীতে প্রবেশ করছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, সুপেয় পানির উৎসে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব যে দিন দিন বাড়ছে, তা একেবারে স্পষ্ট। তবে লবণাক্ততা সমস্যা সমাধানে প্রায় ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নতুন একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
পানি সংকট নিরসনে ৪০ কোটি ডলারের প্রকল্প
বিকল্প ইনটেক স্টেশন নির্মাণ, প্রি-সেটেলমেন্ট রিজার্ভার, নতুন শোধনাগার নির্মাণকে প্রাধান্য দিয়ে এই প্রকল্পের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দুটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা – ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) – আগ্রহী বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ফ্রান্সভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা সুয়েজ একটি ধারণাপত্র দিয়েছে গত বছরের আগস্টে। এই ধারণাপত্রের আলোকে প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) তৈরি করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। যা বর্তমানে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
তবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে প্রকল্পটি কিছুটা ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার একটি সূত্র।
প্রকল্পের নথিপত্রের তথ্যমতে, পানির ভবিষ্যৎ চাহিদা মাথায় রেখে তিন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে ধারণাপত্রে। প্রথম অংশে ভান্ডালজুড়িতে দৈনিক ৮৪ কোটি লিটার অপরিশোধিত পানি সংগ্রহের জন্য ইনটেক স্টেশন ও প্রি-সেটেলমেন্ট রিজার্ভার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া দৈনিক ৬৩ কোটি লিটার সক্ষমতার পানির পাম্প স্টেশন স্থাপন, ভান্ডালজুড়ি থেকে মোহরা ও মদুনাঘাট পানি শোধনাগার পর্যন্ত দৈনিক ৪২ কোটি লিটার সক্ষমতার রিভার ক্রসিং পাইপলাইন (কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে) স্থাপন, মোহরায় দৈনিক ২০ কোটি লিটার সক্ষমতার নতুন পানি শোধনাগার নির্মাণ, সেবার পরিধি বাড়াতে মোহরা থেকে বায়েজিদ লিংক রোড পর্যন্ত পাইপলাইন ও রিজার্ভার এবং সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।
মোহরা পানি শোধনাগারে ব্যবহারোপযোগী জমি থাকায় ধারণাপত্রের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশে আরও দুটি নতুন শোধনাগার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংকট তৈরি হচ্ছে। এখনই আগাম ব্যবস্থা নিতে হবে। ১০ বছর পর সংকট আরও বাড়তে পারে। এজন্য ভবিষ্যৎ সংকটের কথা মাথায় রেখে প্রকল্প সাজানো হয়েছে।"