তাপপ্রবাহে বাড়ছে রোগ, হাসপাতালে বাড়তি রোগীর চাপ
তীব্র গরমে অস্থির জনজীবন। জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, হিট স্ট্রোকসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়।
তাই গরমে সুস্থ্য থাকতে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সুতি কাপড় পরা এবং বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
তারা বলছেন, তীব্র গরম, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানি খাওয়ার কারণেই ঢাকাসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে জ্বর, সর্দি, হিটস্ট্রোক, ডায়রিয়া, টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গরম বাড়লে আরও রোগী বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।
আইসিডিডিআর,বির হাসপাতালে সাধারণত প্রতিদিন গড়ে ৩০০ ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তবে বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রায় ৫০০ জনে গিয়ে ঠেকেছে। এরমধ্যে ৬০ শতাংশ শিশু এবং বাকি ৪০ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক রোগী রয়েছেন বলে জানান সেখানকার চিকিৎসকরা।
শিশু হাসপাতালে গড়ে ৭০০ থেকে ৯০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। একইভাবে, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারেও বেড়েছে রোগীদের চাপ।
আইসিডিডিআর,বি-এর হাসপাতাল প্রধান ডা. বাহারুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আইসিডিডিআর,বি-তে দিনে ৭০০ এর বেশি রোগী ভর্তি হলে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। গ্রীষ্মের শুরুতে এখনও সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে রোগী বাড়ছে।"
"গরমে ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, খাবার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে যারা শিশুদের খাওয়ান, যত্ন নেন, তাদের এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে," যোগ করেন ডা. বাহারুল আলম।
আইসিডিডিআর,বি বলছে, তীব্র গরমে শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, রিকশাচালক, কৃষক ও নির্মাণশ্রমিকদের মত শ্রমজীবী, যাদের ওজন বেশি এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ– বিশেষ করে যাদের হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ আছে– এমন ব্যক্তিরা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া রোগী বেশি
গত কয়েকদিন ধরেই দেশে তাপতাহ বয়ে যাচ্ছে। বুধবার (১৭ এপেইল) দুপুর ৩ টায় সব রেকর্ড ভেঙ্গে এ বছর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায়।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে মাঝারি থেকে তীব্র তাপ প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বৈশাখের শুরুতে গরমে হাঁপিয়ে উঠছে মানুষ।
গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার হাসপাতালগুলোতেও গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
ঈদের পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গরমজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু ভর্তির হারও বেড়েছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সাহিদা ইয়াসমিন জানান, "এই গরমে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। এছাড়া জ্বর, সর্দি, কাশি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু ভর্তির হারও বাড়ছে। হাসপাতালের চারটি ওয়ার্ডে এখন ৫০০ মতো শিশু ভর্তি আছে।"
গরম বৃদ্ধির সাথে সাথে নারায়ণগঞ্জে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। শহরের ১০০ শয্যা বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে ঈদের পর থেকে দৈনিক গড়ে ৫০ জন রোগী সেবা নিচ্ছেন ডায়রিয়ার বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে।
হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ শিউলি আক্তার বলেন, "এখন দৈনিক গড়ে ৫০ জন রোগী আসছেন। ঈদের পর রোগীদের চাপ বেড়েছে। গরমের কারণে ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা রোগীদের পর্যাপ্ত স্যালাইন ও ঔষধ প্রদান করে যাচ্ছি।"
নওগাঁ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বেড সংখ্যা ১৫টি হলেও সেখানে ভর্তি রয়েছে ৫৬ জন। এরমধ্যে ডায়রিয়া রোগী ২৬ জন। হাসপাতালে থেকে বাড়তি রোগীদের জন্য অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ৭০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন, যার অধিকাংশই ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।
গরমে সুস্থ্য থাকতে চিকিৎসকের পরামর্শ
ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, দেশে বর্তমানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ তাপমাত্রা শিশু থেকে বয়স্ক সবার জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি বলেন, "এখন সুস্থ্য থাকতে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। অপ্রোয়জনে একদমই বাইরে ঘোরাঘুরি করা যাবেনা। যারা কাজের জন্য বাইরে থাকেন, তাদের ছাতা ব্যবহার বা মাথায় কাপড় দিতে হবে। তবে রোদে যারা কাজ করেন, কারো একটানা দীর্ঘক্ষণ কাজ করা যাবেনা। এতে করে মাথা ব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা থেকে হিটস্ট্রোক হয়। আর হিটস্ট্রোক হলে যে কেউ মারাও যেতে পারে।"
গরমে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পানিশূন্যতা। তাই পর্যাপ্ত পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন ডা. এবিএম আবদুল্লাহ।
"ওরাল স্যালাইন খাওয়া ভালো। এছাড়া, পানিতে লবণ মিশিয়েও খাওয়া যাবে। তবে রাস্তায় বিক্রি হওয়া লেবু পানি, আখের সরবত খাওয়া যাবেনা। অস্বাস্থ্যকর, বাসি কোনো খাবার খাওয়া যাবেনা। শিশু ও বয়স্কদের যতটা সম্ভব ঘরে রাখতে হবে," যোগ করেন তিনি।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটুও গরমে সুস্থ্য থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি ও খাবার স্যালাইন পান করার পরামর্শ দেন।
একইসঙ্গে তিনি বলেন, "গরমে সুস্থ থাকতে সুতি ও হালকা রঙের, বিশেষ করে সাদা কাপড় পরতে হবে। একটানা বাইরে কাজ করা যাবেনা। রিকশাচালক, হকার বা যারা বাইরে কাজ করেন– তারা যেনো কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নেন। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে ঠাণ্ডা পানি খাওয়া যাবেনা, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর পানি খেতে হবে।"