এমপি আজীম হত্যাকাণ্ড: নেপথ্যে সোনা চোরাচালান নিয়ে বিরোধ?
ঝিনাইদহ-৪-এর সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার 'সোনা চোরাচালান নিয়ে মতবিরোধের জের ধরে খুন' হতে পারে বলে সন্দেহ করছেন পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দারা। গত ১৩ মে কলকাতা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের অপরাধ তদন্ত বিভাগের মহাপরিদর্শক অখিলেশ চতুর্বেদী স্থানীয় মিডিয়াকে জানান, চোরাচালান চক্রে সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজনকে গতকাল তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এদিকে ভারতীয় পুলিশের একটি বিশেষ দল বাংলাদেশ পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে মামলার তথ্য বিনিময় করতে ঢাকায় এসেছিলেন। সফররত ভারতীয় দলের সঙ্গে দেখা করার পর বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত ৩-৪ মাসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনার চালান আটক করেছে। তাদের ধারণা বনগাঁ ও ভারত-বাংলাদেশ অন্যান্য সীমান্ত বরাবর এই জব্দগুলি হত্যার সূত্রপাত করেছে।"
ভারতীয় দলের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, "আজীম সোনা চোরাচালান' নিরাপদে নিশ্চিত করতে মোটা অঙ্কের কমিশন পেয়ে আসছিলেন। তবে সম্প্রতি আজীম বেশি টাকা দাবি করলে তার বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আখতারুজ্জামান শাহিন ক্ষুব্ধ হন।"
এমতাবস্থায় ভারতীয় সীমান্তে শাহিনের কিছু স্বর্ণের চালান আটকের পর বিরোধ দেখা দেয়। এতে নিহত এমপির জড়িত থাকার সন্দেহ করেন তিনি।
ঘটনাচক্রে শাহিন আজীমকে শ্রীলিস্তা রহমান নামে এক নারীর মাধ্যমে প্রলুব্ধ করে কলকাতায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে সেখানে তাকে হত্যা করা হয়।
মামলার সাক্ষীদের জেরা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ একত্র করতে গতকাল ভারতীয় পুলিশের একটি দল ঢাকায় এসেছে। তারা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে অভিযুক্ত হিটম্যান আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
এদিকে গতকাল (বৃহস্পতিবার) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, "আজীম ভারতে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল কিনা তা তদন্ত করে জানা যাবে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি কিছু বলতে পারব না। আওয়ামী লীগে অপরাধীদের কোনো স্থান নেই।"
তিনি আরও বলেন, "প্রধানমন্ত্রী কোনো অন্যায়কারীকে রেহাই দেন না। যদি তারা নিজ দলেরও হয়ে থাকেন তবুও। অপরাধ সম্পর্কে তার জিরো টলারেন্স নীতি।"
ইন্টারপোলের সাহায্য নিতে পারে বাংলাদেশ
তদন্তকারীরা জানান, হত্যার পিছনে অভিযুক্ত আখতারুজ্জামান শাহিন একজন মার্কিন নাগরিক। তিনি বিদেশে অবস্থান করার কারণে বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সাহায্য চাইতে পারে।
পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, শাহিন ৩০ এপ্রিল ভারতে যান এবং বিমানে বাংলাদেশে ফেরার আগে ১০ মে পর্যন্ত অবস্থান করেন। ১৮ মে তিনি নেপালে চলে যান এবং ২২ মে তিনি দুবাই পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি গতকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ফ্লাইটে উঠবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
শাহিনের ভাই ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মোঃ শহিদুজ্জামান টিবিএসকে নিশ্চিত করেছেন যে, তার ভাই এখন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তারা দুবাইতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু তাদের জানানো হয়, শাহিন মার্কিন নাগরিক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে তারা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন না।
এই বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত শাহিনের সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তার কাছ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শাহিন নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। তিনি হত্যার সাথে নিজেকে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে এবং এমপি আনারকে হত্যার জন্য কাউকে তিনি ভাড়া করেননি।
এদিকে শাহীনকে বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্র বিভাগের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, "এর পরিবর্তে বাংলাদেশ সম্ভাব্য বিচারের জন্য ওয়াশিংটনের সাথে যোগাযোগ শুরু করতে পারে। হত্যার তদন্তে তার জড়িত থাকার তথ্যও ঐ দেশের সাথে শেয়ার করা যেতে পারে।"
পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (ইন্টারপোল ডেস্ক) এর সহকারী মহাপরিদর্শক আলী হায়দার চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "তদন্তকারী সংস্থা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও তথ্যের জন্য সহায়তার অনুরোধ করে তবে তারা ইন্টারপোলের সহায়তা চাইতে পারে।"
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দফতরের অন্য একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "শাহিন একজন মার্কিন নাগরিক হওয়ায় তাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করা যাবে না। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই।"
ঐ কর্মকর্তা বলেন, "বাংলাদেশের বর্তমানে শুধুমাত্র দুটি দেশের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে; থাইল্যান্ড ও ভারত। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে একটি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স (এমএলএ) চুক্তি রয়েছে।" এছাড়া নিহতের লাশ বা আংশিক দেহাবশেষ উদ্ধার না করা হলে বিচার প্রক্রিয়া আরও জটিল হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, "শিমুল ভূঁইয়া নামে পরিচিত হিটম্যান আমানুল্লাহকে ভারতে নিয়ে গিয়ে হত্যার জায়গাটি ফের পরিদর্শন করলে মরদেহের অঙ্গগুলি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় অগ্রগতি আসতে পারে।"
ঐ কর্মকর্তা জানান, একজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, একজন পুলিশ সুপার এবং একজন অতিরিক্ত এসপির সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল তদন্ত করতে ভারতে যেতে পারে।
তিনি বলেন, "আমরা ইতোমধ্যেই কলকাতায় যাওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দফতরের সাথে যোগাযোগ করেছি। মৃতদেহের অংশগুলি পুনরুদ্ধার করা আমাদের প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার।"
তিন মাস ধরে চলে আজীমকে হত্যার পরিকল্পনা
ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ গতকাল (বৃহস্পতিবার) বলেন, "হত্যার কথিত মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিন গত তিন মাস ধরে আজীমকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিলেন।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, "১৩ মে দুপুর ২টা ৫১ মিনিট থেকে এমপিকে হত্যা করতে ৩০ মিনিট সময় লেগেছিল।"
আনোয়ারুল আজীম হত্যার ঘটনায় ভারতের কলকাতা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, খুনের আগে লাশ গুমের পরিকল্পনা সাজান খুনিরা। এ জন্য তাঁরা ট্রলি ব্যাগ, চাপাতি, ব্লিচিং পাউডার, পলিথিনসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে রাখেন।
১৩ মে কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে আনোয়ারুলকে হত্যার পর লাশ টুকরা টুকরা করে ব্যাগে ভরে সরানো হয়েছে। এর কিছু অংশ কলকাতার একটি খালে ফেলা হয়েছে। কলকাতার পুলিশ খুনিদের ভাড়া ফ্ল্যাটের ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এবং ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে আনার হত্যার ঘটনায় দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি। এদের মধ্যে জিহাদ হাওলাদার নামের এক বাংলাদেশিকে মুম্বাই থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর গতকাল বনগাঁ এলাকা থেকে গভীর রাতে জাহিদ নামের আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির সূত্রের দাবি, ২৪ বছর বয়সি জিহাদ পেশায় একজন কসাই। তিনি কোলকাতা বিমানবন্দরের কাছে একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন।
সূত্রের দাবি, আনারকে হত্যার জন্য জিহাদকে মুম্বাই থেকে এনেছিলেন হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত আখতারুজ্জামান শাহীন। তিনি একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক।
গ্রেফতারকৃত জিহাদ খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলা বারাকপুর এলাকার জয়নাল হাওলাদারের ছেলে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মুম্বাইতে একজন অবৈধ অভিবাসী হিসেবে থাকছিলেন।
সূত্রমতে, জিহাদ দুই মাস আগে ভাড়ায় মুম্বাই থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। তাকে ৫ কোটি টাকার ভাগ দেওয়া হয়েছিল; যা প্রধান অভিযুক্ত শাহীন এমপিকে হত্যার জন্য ব্যয় করেছেন বলেন অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় পৃথক অভিযানে সিআইডির একটি দল আজীমের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সন্ধানে কলকাতার কাছে ভাঙ্গারের কৃষ্ণমতি গ্রামে অভিযান চালায়। তবে দলটি এমপির মরদেহের কোনও অংশ খুঁজে পেয়েছে কি-না সে বিষয়ে এখনও স্পষ্টভাবে জানায়নি।
গ্রেফতারকৃত জাহিদ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বনগাঁর বাসিন্দা। পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির তথ্যমতে, তিনি এই হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজনদের একজনের সাথে দেখা করেছিলেন।
এদিকে ঢাকায় আজীমের পরিবারের দায়ের করা এফআইআর-এ জাহিদের নাম ছিল। এই তথ্যের ভিত্তিতেই পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি তাকে গ্রেফতার করেছে।
এক্ষেত্রে জাহিদ কেন সন্দেহভাজন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেছিল এবং তাদের আলোচনার বিষয়গুলি কী ছিল তদন্তের মাধ্যমে বের করার চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, "সন্দেহ করা হচ্ছে যে, এমপি আজীমকে হত্যাকারীদের নিউ টাউনে গাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ মালামাল সরবরাহ করেছে জাহিদ।"