চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা: ৪ প্রকল্পে ৮,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরও রাস্তাঘাট এখনো পানিতে সয়লাব
উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এবং সমস্যা মোকাবেলায় তিনটি সংস্থার চলমান প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার কোনো সমাধান পাচ্ছে না নগরবাসী।
বন্দর নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিন সংস্থা।
গত দশ বছরে এসব প্রকল্পে পেছনে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ও হয়েছে। এরমধ্যে চলতি অর্থবছরে প্রকল্পগুলো বরাদ্দ পেয়েছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যার বেশিরভাগই ব্যয় হয়েছে। তবুও জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাননি নগরবাসী।
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে তিন ঘণ্টায় ১৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নগরীর নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতেও হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি উঠে গেছে। খালে পড়ে মৃত্যু হয়েছে একজনের।
এর আগে গত চার বছরে নালা ও খালে পড়ে আরও নয় জনের মৃত্যু হলেও দায় নেয়নি কেউ। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া নেওয়া এসব প্রকল্পে মেয়াদের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ব্যয়। বিপরীতে সুফল না মেলায় ক্ষুব্ধ নগরবাসী।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিশান বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার টিবিএসকে বলেন, "সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এক সংস্থা অন্য সংস্থাকে দুষছে। এরপর ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো ঠিক করা হয়নি।"
তিনি বলেন, "প্রকল্পগুলোর পেছনে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল আসছে না। খাল সংস্কার করা হলেও কোথাও না কোথাও বাধা রয়েছে। ফলে পানি নামতে পারছে না। রেগুলেটর স্থাপন করা হলেও পাম্প বসিয়ে তা ফাংশানাল করা হয়নি। ফলে রেগুলেটর স্থাপনের অগ্রগতির সুফল মানুষ পাচ্ছে না। যার কারণে আবারও বর্ষায় মানুষকে জলাবদ্ধতায় হাবুডুবু খেতে হবে।"
'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটি নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। সেনা বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডকে প্রকল্পটির ঠিকাদার নিয়োগ করার পর ২০১৮ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ফলে দফায় দফায় প্রকল্প কাজ ও নকশায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। নগরীর ৩৬টি খাল খনন, সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ চলছে প্রকল্পটির অধীনে। বর্তমানে প্রকল্পটির অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির অধীনে পাঁচটি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন করা হয়েছে। বাকি একটি খালের মুখের রেগুলেটর এখনো নির্মাণ হয়নি। বর্ষায় বালু আটকাতে খালগুলোতে মুখে সিল্টট্র্যাপ নির্মাণের কথা থাকলে, এ কাজ এখনো শেষ হয়নি।
২ হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে 'কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ' প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। ২০১৭ সালে নেওয়া প্রকল্পটিতে পাঁচ বছর পর নতুন করে ১৮ ধরনের স্থাপনা যুক্ত করা হয়। দুই দফায় প্রকল্প ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়ে সম্পন্ন করতে পারছে না সংস্থাটি। ইতোমধ্যে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ২৪২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রকল্প অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
প্রকল্পটির অধীনে ৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন, ড্রেন, ওয়াকওয়ে, পাম্প হাউজ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মাণের কথা রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৬টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। জোয়ারের সময় বৃষ্টিপাত হলে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন হলেও পাম্প বসানো হয়নি। আগামী মাসে দুটি পাম্প বসানো হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি দায়িত্ব নেওয়া পরও জেনেছি সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া প্রকল্প হয়েছে। এটি সময়সাপেক্ষ কাজ। আগের বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না। জলাবদ্ধতা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কাজ করছি। চট্টগ্রাম ওয়াসা ও কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, তাদের পাইপলাইনের কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন হয় না। এছাড়া সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি।"
২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পটি ২০১৪ সালে নিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও প্রকল্পের কাজ শেষ করেটি পারেনি চসিক। এরমধ্যে ব্যয় বেড়ে ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা হয়েছে। চলতি জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলে প্রকল্প অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। ইতোমধ্যে ১ হাজার ৩২২ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
এছাড়া ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিভিন্ন সংস্থার আপত্তি, নকশা পরিবর্তন ও অর্থ ছাড়সহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ২০১৮ সালে নেওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ। খরচ হয়েছে প্রায় ৪৪৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। চলতি বছরের জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
সিডিএর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীতে মোট ১৬০০ কিলোমিটার নালা রয়েছে। এরমধ্যে সিডিএ জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় কাজ করছে মাত্র ৩০০ কিলোমিটার। বাকিগুলো পরিষ্কারের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। সেটি তারা না করায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
এদিকে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, "জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। বৃষ্টি হলেই পানি উঠবে। দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। চসিক-সিডিএ সমন্বয় করে কাজ করছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আন্তঃদপ্তর সমন্বয় সভায় সব সংস্থার সমন্বয়ে 'কুইক রেসপন্স টিম' গঠন করা হয়েছে। যেন পানি উঠলে তা দ্রুত নিষ্কাশনে পদক্ষেপ নেওয়া যায়।"