বেনজীরনামা: আলাদিনের চেরাগের সম্পদ-কাহিনি!
তিনি যেন ছিলেন 'রাজা'। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্তা, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশবাহিনীর নেতা। প্রায় পাঁচ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের এলিট বাহিনী র্যাবের। তারপর প্রায় আড়াই বছর গোটা পুলিশ বাহিনীর নেতা। 'সততার' জন্য পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার। এছাড়া পাঁচবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ মেডেলও (বিপিএম) পেয়েছেন।
নজিরবিহীন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বেনজীর আহমেদ। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল। গণেশ উল্টে গেল। 'রাজা' তাহলে রাজা নন, জানা গেল তিনি ছিলেন 'ভূমিদস্যু। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে বেরিয়ে আসছে তার দুর্নীতির হিসাব। 'ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয়, একচ্ছত্র ক্ষমতা একচ্ছত্র দুর্নীতির জন্ম দেয়'—লর্ড অ্যাকটনের ১৩৭ বছর আগের করা বিখ্যাত এ উক্তির আদর্শ উদাহরণ তিনি!
বেনজীর শিল্পপতি ছিলেন না, বংশপরম্পরায় বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকও ছিলেন না। তাহলে কী করে রাতারাতি পাহাড়সমান সম্পদের মালিক বনে গেলেন? এখন পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় যেসব খবর বেরিয়েছে, তাতে জানা গেছে, প্রায় ৭০০ বিঘা জমি কিনে তিনি হয়েছেন 'ল্যান্ডলর্ড'। আরও কত কী! পত্রপত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছে, সেই ফিরিস্তি দিতে গেলে লিখতে হবে 'বেনজীরনামা'।
কোথা থেকে কী হয়ে গেল, হঠাৎ একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলো, 'বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ'। আর সেই আলাদীনের চেরাগ থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে লাগল সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরের সম্পদের কাহিনি!
সম্প্রতি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ ওঠে। বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল সম্পদের তথ্য তুলে ধরে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হওয়ার সম্পদের অনুসন্ধানের দাবি ওঠে।
এরপর তার আয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধান করতে নামে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)। অনুসন্ধানে বেনজীরের বিপুল সম্পত্তির খোঁজ পায় সংস্থাটি। এরপর দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোম্পানির শেয়ার ক্রোক করার নির্দেশ দেন আদালত।
দুদক এখন পর্যন্ত বেনজীর ও তার পরিবারের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে ৬২১ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার, গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব এবং ৩টি বিও অ্যাকাউন্ট (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) খুঁজে পেয়েছে। আদালতের আদেশে এসব সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
এছাড়া বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে বিদেশে কোনো সম্পদ আছে কি না, তার খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে দুদক। বেনজীরের দেশের বাইরের সম্পদের তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর (বিএফআইইউ) মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও দুবাইয়ের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনজীর, তার স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে চিঠি দিয়েছে দুদক।
চলুন জেনে নিই বেনজীরের যেসব সম্পদের খবর গণমাধ্যমে এসেছে:
সাভানা ইকো রিসোর্ট: 'ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের জমি কিনে নেন বেনজীর'
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় বৈরাগীটোল গ্রামে জমি কিনে বেনজীর গড়ে তুলেছেন সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক।
প্রায় এক হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই ইকো রিসোর্টের বিভিন্ন জায়গায় মাটি ভরাট করে বানানো হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়। সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিং পুলও রয়েছে এখানে। আছে হাজারের বেশি ভিয়েতনামি নারকেলগাছসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। রয়েছে বিশাল আকৃতির কনসার্ট হল। এছাড়াও বেশ কয়েকটি পুকুর ও দৃষ্টিনন্দন ঘাট, কৃত্রিম ঝরনা ও বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কটেজ।
গতকাল শনিবার (১ জুন) প্রথম আলোতে 'ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের জমি কিনে নেন বেনজীর' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, বেনজীর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছ থেকে 'জোর করে' জমি কিনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এ রিসোর্ট।
বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এসব জমির প্রায় সবই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাঁরা বলছেন, জমি বিক্রি ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না। ভয় দেখিয়ে, জোর করে এবং নানা কৌশলে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো কেনা হয়েছে।'
এসব জমি কিনতে বেনজীর একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়োজিত রেখেছিলেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীর এসব জমি কেনা ও রিসোর্ট গড়ার কাজটি করেছেন আইজিপি (২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর) ও র্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময়ে (২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল)।
দুদকের অনুসন্ধানে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের এ পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া ৬২১ বিঘা জমির মধ্যে ৫৯৮ বিঘা গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ও মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। ওই এলাকার গ্রামগুলো হিন্দু অধ্যুষিত। সেখানেই সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক তৈরি করেছেন বেনজীর।
সাগরেও বেনজীর: 'সেন্ট মার্টিনেও জমি কিনেছেন'
শুধু স্থলভাগ নয়, সমুদ্র পাড়েও সম্পত্তি কিনেছেন বেনজীর। 'জমিবিলাসী' এ মানুষটি জায়গা কিনেছেন সাগরসৈকতেও।
২ জুন প্রথম আলোতে প্রকাশিত 'সেন্ট মার্টিনেও জমি কিনেছেন বেনজীর' শিরোনামের সংবাদে বলা হয়েছে, এ দ্বীপে ১০ বছর আগে নিজের নামে ১ একর ৭৫ শতক জমি কেনেন সাবেক এই আইজিপি। এছাড়া কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের ইনানী সৈকতে স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে কেনেন আরও ৭২ শতক জমি। সে সময় বেনজীর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন।
এছাড়া ইনানী সৈকতে ২০০৯ সালে স্ত্রী জীসান মীর্জার নামে বেনজীর ৪০ শতক জমি কেনেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে। পাশাপাশি বেনজীরের তিন মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইশা বিনতে বেনজীর ও জারা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে ১৫ শতাংশ জমি কেনা হয়।
ভাওয়াল রিসোর্টে মালিকানা: 'ক্ষমতার পুঁজিতে ভাওয়াল রিসোর্টের মালিক বেনজীর'
গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা-তেও রয়েছে বেনজীরের মালিকানা। বনভূমি বেষ্টিত এ রিসোর্ট এলাকার মানুষের কাছে 'বেনজীরের রিসোর্ট' নামে পরিচিত বলে উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে।
২ জুন সমকাল-এ প্রকাশিত 'ক্ষমতার পুঁজিতে ভাওয়াল রিসোর্টের মালিক বেনজীর' শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনশ্রুতি রয়েছে, 'পাঁচতারকা মানের ভাওয়াল রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিক হতে এক পয়সাও লগ্নি করতে হয়নি সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদকে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে সমকালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই গাজীপুরের এ রিসোর্টের মালিক বনে গেছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর। শুরুতে ১৯ একর জমি নিয়ে এ রিসোর্টের কাজ শুরু হলেও বেনজীরের ক্ষমতার দাপটে প্রায় ৫০ একর জায়গা দখল করে নেন রিসোর্ট মালিকরা।
বন বিভাগসহ বীর মুক্তিযোদ্ধার জমিও দখল করে ভাওয়াল রিসোর্ট তৈরি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। রিসোর্টটির মূল প্রবেশপথের এক একরের বেশি জমি বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা. সিরাজুল হক এবং তার মায়ের। তিনি নিজের জমি উদ্ধারে নানাজনের কাছে ধরনা দিলেও প্রভাবশালী বেনজীরের কারণে তারা ২০১৩ সালের পর থেকে ওই জমির ধারেকাছেও ভিড়তে পারেননি।
২০১৭ সালে বেনজীর হঠাৎ ভাওয়াল রিসোর্টের সঙ্গে যুক্ত হন বলে এলাকাবাসীর বরাতে উল্লেখ করেছে সমকাল। ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু জমির দখল ছাড়তে রিসোর্টের মালিকপক্ষকে চাপ দেন বেনজীর। এক পর্যায়ে মালিকপক্ষ বেনজীরকে এর অংশীদার করে দিয়ে আপস করে নেয়।
গাজীপুরে 'বেনজীর পরিবারের ৫০ বিঘা জমি'
রাজধানীর পূর্বাচল উপশহর ঘেঁষে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের পাশের চান্দখোলা মৌজার বেতুয়ারটেক গ্রামে বেনজীর বিঘার পর বিঘা জমি কিনেছেন বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আজ (রবিবার) কালের কণ্ঠে 'বেনজীর পরিবারের ৫০ বিঘা জমি গাজীপুরেও' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কালীগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে তল্লাশি চালিয়ে বেনজীর ও তার স্ত্রী এবং বড় মেয়ের নামে দুদক পাঁচটি দলিল পেয়েছে।
বেতুয়ারটেক গ্রামে বাসিন্দা মো. শাহীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বেনজীর আহমেদ এই এলাকায় জমি কেনা শুরু করেন। এসব জমি কেনা হয় বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা এবং বড় মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে।
মালয়েশিয়ায় 'সেকেন্ড হোম'
মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি 'মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম' প্রকল্পের অধীনে বেনজীর আহমেদ বিপুল বিনিয়োগ করেছেন।
আজ যুগান্তর-এ 'বিদেশে নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তি: মালয়েশিয়ায় বেনজীরের 'সেকেন্ড হোম' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলা হয়েছে, দেশ থেকে অর্থ নিয়ে মালয়েশিয়ার আবাসন খাতে লগ্নি করার পাশাপাশি সেখানে বাড়ি কিনেছেন বেনজীর। সিঙ্গাপুরে স্ত্রীর চিকিৎসা শেষে মালয়েশিয়ার ওই বাড়িতে গিয়েই আপাতত সপরিবারে বসতি গেড়ে থাকতে পারেন।
মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকে বেনজীরের অর্থ লেনদেনের সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণও আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
মালয়েশিয়ার হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ন কবিরের মাধ্যমেও বেনজীর বিপুল টাকা পাচার করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, হুমায়ন ও রতনের মাধ্যমে পাচার করা টাকায় পরিবারের থাকার জন্য একটি অত্যাধুনিক বাড়ি কিনেছেন বেনজীর। বিনিয়োগ করেছেন আবাসন খাতে।
'ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ইটভাটা দখলে নেন বেনজীরের শ্যালক'
বেনজীরের প্রভাব কাজে লাগিয়ে সম্পত্তি বাগিয়েছেন তার শ্যালকও।
আজ রবিবার (২ জুন) 'কালের কণ্ঠে' প্রকাশিত এ 'ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ইটভাটা দখলে নেন বেনজীরের শ্যালক' শিরোনামের সংবাদে বলা হয়েছে, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দক্ষিণ আলীপুর গ্রামে ৪৮ বিঘা জমির ওপর একটি আধুনিক ইটভাটা স্থাপন করেছিলেন আনারুল ইসলামের ছেলে আশরাফুজ্জামান হাবলু। কিন্তু পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ইটভাটাটি যাত্রা শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই দখল করে নেন বেনজীর আহমেদের শ্যালক মির্জা আনোয়ার পারভেজ। ভগ্নিপতির ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে হাবলুর কাছ থেকে ইটভাটাটি দখল করেন পারভেজ।
ইটভাটা দখলের জন্য হাবলুকে চারবার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। ওই সময় বেনজীর র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।
আশরাফুজ্জামান হাবলু কালের কণ্ঠকে বলেন, ইটভাটার কাজ শুরু হওয়ার পর একপর্যায়ে তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখান বেনজীরের শ্যালক মির্জা আনোয়ার পারভেজ। একসময় ভগ্নিপতি বেনজীরের 'ক্ষমতার দাপটে' পারভেজ তার কাছ থেকে ইটভাটা লিখে নেন বলে উল্লেখ করেন হাবলু।
এছাড়া সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ১ নম্বর শোভনালী ইউনিয়নের শরাফপুর গ্রামে বেনজীরের শাশুড়ি লুত্ফুন নেসার নামে শতাধিক বিঘার ওপর চারটি মাছের ঘের আছে বলে উল্লেখ করা কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে। পাশাপাশি আরকুনি মৌজায় দুটি, পশ্চিম বিল আর পাশের পুঁটিমারি বিলেও আরও কয়েকটি মাছের ঘের রয়েছে।
গুলশানে এক দিনে 'পানির দামে' ৪ ফ্ল্যাট ক্রয়
দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ৫ মার্চ বেনজীর আহমেদ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে মোট ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট আয়তনের চারটি ফ্ল্যাট মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখ টাকায় কিনেছেন। এই হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বর্গফুটের দাম পড়েছে ২ হাজার ৩৮২ টাকা।
তবে রাজধানীর আবাসন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকা তো দূরের কথা, ঢাকার উপকণ্ঠের কোনো এলাকাতেও এরকম 'পানির দামে' এই আয়তনের ফ্ল্যাট পাওয়া যায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) একাধিক সদস্য টিবিএসকে জানান, জমির দামের সঙ্গে নির্মাণ ব্যয় সমন্বয় করে ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে গুলশান-বনানীতে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট প্রতি বর্গফুট ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তারা জানান, নামী রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর ফ্ল্যাটের দাম আরও বেশি। সে হিসেবে ৯ হাজার বর্গফুট রিয়েল এস্টেটের মূল্য কমপক্ষে ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
মাদারীপুরে বেনজীরের স্ত্রীর বিপুল জমি
মাদারীপুরে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে ২৭৩ বিঘা জমি কেনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা বলে উঠে এসেছে একটি প্রতিবেদনে।
২৭ মে কালের কণ্ঠে 'বেনজীরের স্ত্রীর সাম্রাজ্য মাদারীপুরেও' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বেনজীর আহমেদ অবসরে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে স্ত্রী জীশান মীর্জার এসব জমি কেনা হয়। এসব জমির রেজিস্ট্রি মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ২১ লাখ টাকা।
২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ১৬ আগস্টের মধ্যে মাদারীপুরের এসব জমি কেনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'আদালতে উপস্থাপন করা দুদকের গতকালের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেড় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে ১১৪টি দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়।'
মেয়ের 'বিশ্রামের জন্য' সাড়ে ৩ কোটি টাকার ফ্ল্যাট
মেয়ে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিতে পারেন, যেজন্য বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট কেনেন বেনজীর। বেনজীর আহমেদের বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ক্লাসের বিরতির সময় তিনি যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে বিশ্রাম নিতে পারেন, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেই এই ফ্ল্যাট কেনা হয় বলে উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার এই ফ্ল্যাট নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে।
চলতি বছরের ৩১ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত 'মেয়ের বিশ্রামের জন্য সাড়ে ৩ কোটি টাকার ফ্ল্যাট' শিরোনামের ওই সংবাদে বলা হয়, ২০১৭ সালে র্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালে সাড়ে ৩ হাজার বর্গফুটের এ ফ্ল্যাট কেনেন বেনজীর।
এছাড়া বেনজীরের দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল 'লা মেরিডিয়ান'-এর ২ লাখ শেয়ার রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদে। ৫৫ টাকা অধিমূল্যে ৬৫ টাকা প্রতিটি শেয়ারের দর হিসাবে এই কোম্পানিতে বেনজীরের দুই মেয়ের বিনিয়োগ ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালে বেস্ট হোল্ডিংসের দুই লাখ শেয়ার দুই মেয়ের জন্য কেনেন বেনজীর আহমেদ। ওই সময় র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।'
দেশে-বিদেশে বেনজীরের এরকম আরও অনেক সম্পত্তি থাকতে পারে। সেসব সম্পত্তির সন্ধানে কাজ করছে দুদক।
দুদক ডেকেছে ৬ জুন, কিন্তু কোথায় বেনজীর?
তবে যাকে নিয়ে এত শোরগোল, সেই বেনজীর এখন কোথায় আছেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তিনি কোথায় আছেন, কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না। একের পর এক খবর প্রকাশ হওয়ার পর কানাঘুষা চলছে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
কেউ বলছে, বেনজীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন, কেউ বলছে তিনি দুবাইয়ে আছেন। তবে তার দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাই বেশি বলা হচ্ছে।
বেনজীর আহমেদ দেশে আছেন নাকি চলে গেছেন, সে ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও।
শনিবার (১ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'তাকে আমরা এখনো নিষেধাজ্ঞা দিইনি। সে যদি নিষেধাজ্ঞার আগে চলে গিয়ে থাকে...। আমি এখনও কিন্তু সঠিক জানি না, সে আছে নাকি চলে গেছে। আমাকে জেনে কথা বলতে হবে। তিনি আছেন কি না, না আছেন, সেটা আমি এখনও সুনিশ্চিত নই।'
হঠাৎ করে বেনজীরের এই উধাও হয়ে যাওয়ার সঙ্গে রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদ ছেড়ে মুন্সীগঞ্জে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনার অনেকটাই মিল পাওয়া যায়।
লক্ষ্মণ সেন ছিলেন মধ্যযুগীয় বাংলার সেন রাজবংশের চতুর্থ ও বাংলার সর্বশেষ হিন্দু রাজা। তিনি ১১৭৮ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। তিনি তার রাজত্বকে কামরূপ (বর্তমানে আসাম), কলিঙ্গ (বর্তমান উড়িষ্যা), কাশী, প্রয়াগরাজ ও দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন।
১২০৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি সালতানাতের তুর্কী সেনা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী গৌড় আক্রমণ করলে লক্ষণ সেন পালিয়ে গিয়ে পূর্ববঙ্গের মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কথিত আছে যে রাজা লক্ষণ সেন প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
তাই এখন প্রশ্ন উঠছে যে যদি বেনজীর দেশের বাইরে চলে গিয়েই থাকেন, তাহলে কোন দরজা দিয়ে তিনি গেলেন?