রাসেলস ভাইপারের আক্রমণ বেড়েছে, তবে এ সাপ নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে বেশি: বিশেষজ্ঞরা
রাজশাহী অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপে কাটা মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। তবে গুজব ছড়িয়েছে তার চেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বাড়ার বিষয়টি সঠিক। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাপটি নিয়ে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন গুজব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা।
গুজব ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে জানিয়ে তারা বলছেন, রাসেলস ভাইপার হিসেবে ভুলভাবে চিহ্নিত করে অনেক নির্বিষ সাপ মারা হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে প্রকৃতির ভারসাম্যে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ২১ জুন পর্যন্ত হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছেন ৩২৮ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১১ জন। এ বছর রাসেলস ভাইপারের কামড়ের শিকার ১৮ জনের মধ্যে মারা গেছেন ছয়জন।
অন্যদিকে গতবছর ভর্তি হওয়া ৩৬২ জন সাপে কাটা রোগীর মধ্যে মারা যান ৪৩ জন। এর মধ্যে ১৮ জন মারা গেছেন রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. শঙ্কর কে. বিশ্বাস জানান, সাপে কাটার পর যে-সব রোগী হাসপাতালে আসেন, তাদের পরিসংখ্যান এটি। 'কামড়ানোর পর মারা যাওয়া আরও অনেকে থাকতে পারেন, যাদের পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই।'
রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার রোগীরা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার নদী-তীরবর্তী ও গ্রামীণ প্রান্তিক উপজেলা থেকে আগত বলে জানান তিনি।
'তবে এখন পর্যন্ত রাজশাহী শহর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে রাসেলস ভাইপার সাপে কাটা কোনো রোগী হাসপাতালে আসেননি,' বলেন শঙ্কর বিশ্বাস।
রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, যেভাবে রাসেলস ভাইপারের নামে গুজবের ছড়িয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে তা কোনোভাবেই ঠিক না।
"গুজব ছড়ানোর কারণে রাসেলস ভাইপারের নামে নির্বিষ সাপ মারা হচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও রাসেলস ভাইপারের নামে নির্বিষ 'বোড়া সাপ' দেখানো হচ্ছে," বলেন তিনি।
'আমার কাছে প্রতিদিন হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন এলাকা থেকে রাসেলস ভাইপার সাপের কথা বলে ছবি তুলে পাঠানো হচ্ছে, যেগুলো আদতে রাসেলস ভাইপার না,' জানান এ কর্মকর্তা।
রাসেলস ভাইপার খুবই নিরীহ ও অলস প্রকৃতির একটি সাপ উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর কবির বলেন, 'কেউ আঘাত না করলে এটি কামড়ায় না। তেড়ে এসে কামড়ানোর কোনো রেকর্ড নাই।'
'গুইসাপ রাসেলস ভাইপারকে খেয়ে ফেলে। কিন্তু আমরা গুইসাপ থেকে শুরু করে নির্বিষ সাপ মেরে তাদের আবাসস্থল নষ্ট করে ফেলছি। আপনি অন্য সাপ মেরে ফেললে রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা তো কিছুটা বাড়বেই।'
যে-সব এলাকায় রাসেলস ভাইপার বেড়েছে সেখানে সতর্ক থাকার উপায় হিসেবে তিনি পায়ে গামবুট ও হাতে গ্লাভস পরে ঘরের বাইরে কাজ করার পরামর্শ দেন। 'সাপ মারাটা তো কোনো সমাধান না,' বলেন তিনি।
তবে রাজশাহীতে এ সাপের উপদ্রব কি পরিমাণ বেড়েছে তা তিনি বলতে পারেননি। 'বৈজ্ঞানিকভাবে জরিপ না হওয়ার কারণে ঠিক কি পরিমাণ রাসেলস ভাইপার সাপ বেড়েছে তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাসেলস ভাইপারের নামে যা দেখানো হচ্ছে সেটা রাসেলস ভাইপার না।'
২০১৯ সালে দেশে প্রথমবারের মতো সাপের বিষের ডেটাবেজ তৈরি করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু রেজা। দেশের অভ্যন্তরে পাওয়া সাপগুলোর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নাম, খাদ্যাভ্যাস, প্রকার, প্রকৃতিসহ জীবনবৃত্তান্ত বিস্তারিত স্থান পায় সেখানে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থিত দেশের একমাত্র ভেনম রিসার্চ সেন্টারের কো-ইনভেস্টিগেটর হিসেবেও কাজ করা এ বিজ্ঞানী টিবিএসকে বলেন, রাসেলস ভাইপার সাপ তেড়ে কামড়াতে আসে বলে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে তা ঠিক না।
'যখন এটি গায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয় অথবা হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করে, তখন কামড়ায়। দেখতে পেলে তেড়ে কামড়াতে আসার কোনো ইতিহাস নেই।'
তবে জলবায়ুর পরিবর্তন ও আবহাওয়া উত্তপ্ত হওয়ার কারণে রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান এ অধ্যাপক। 'আগে যেখানে শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলে এ সাপ দেখা যেত, ভৃপৃষ্ঠের উত্তাপ বৃদ্ধির কারণে এখন এটি ২২ থেকে ২৪টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
আতঙ্কিত না হয়ে এ সময়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ড. মো. আবু রেজা।