চোখে গুলি: অনেকেই স্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকিতে
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘটিত সংঘর্ষে হতাহত চার শতাধিক মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছে ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। হতাহতদের অধিকাংশ ছররা গুলিতে ও ইট-পাটকেলে আহত হন। এরমধ্যে আহতদের ৬৯ শতাংশ মানুষকে চোখের অপারেশন করাতে হয়েছে।
হাসপাতালের রেসিডেন্ট সার্জনের কার্যালয় জানিয়েছে, ১৮ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ৮ দিনে ৪৪১ জন মানুষ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছেন। এরমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩০ জন এবং ৩০৬ জনের অপারেশন করাতে হয়। এছাড়া ৩২০ জন রোগীকে ইতোমধ্যে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে, ২৬ জুলাই প্রতিষ্ঠানটিতে গুলিবিদ্ধ কিংবা হতাহত হয়ে নতুন কেউ চিকিৎসা গ্রহণ করতে আসেনি এবং কারো অপারেশনের প্রয়োজন হয়নি বলে জানা গেছে।
শনিবার (২৭ জুলাই) হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শনিবারেও ৫০ জনের বেশি রোগী ফলোআপ চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন এবং অধিকাংশেরই পুনরায় সার্জারি করার প্রয়োজন নেই।
গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, "চোখে বিভিন্ন ধরনের আঘাত নিয়ে যারা এসেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছররা গুলিতে আহত। এখন জরুরি বিভাগে রোগীর চাপ কমেছে। এখন যারা আসছে, তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার চিকিৎসার জন্য আসছে।"
"কতজন চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবেন, এখনই বলা যাচ্ছে না। অনেকের আরও দুই থেকে তিনটি চোখের সার্জারি করলে বোঝা যাবে। তবে অনেকের চোখের দৃষ্টি না ফেরার আশঙ্কা রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
গত ১৮ জুলাই সবচেয়ে বেশি ১৫১ জন রোগী প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসা নিতে আসেন। এরমধ্যে ১৪৩ জনকে ভর্তি করানো হয় এবং ৬৬ জনের অপারেশন করতে হয়। আবার একদিনে সবচেয়ে বেশি অপারেশন করতে ১৯ জুলাই। এদিন ১০৩ জন আহত রোগী আসেন, যার মধ্যে ৯৩ জনের অপারেশন করাতে হয় এবং ৬৩ জনকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এছাড়া ২০ জুলাই ৭১ জনের মধ্যে ৬৮ জনের অপারেশন করাতে হয় এবং ৫৮ জনকে ভর্তি করা হয়। ২১ জুলাই ৬৫ জন রোগী আসেন, যার মধ্যে ৪০ জনকে ভর্তি করা হয় ও ২৫ জনের অপারেশন করা হয়। একইভাবে, ২২ জুলাই আসেন ৩০ জন; এরমধ্যে ২২ জনের অপারেশন করে, বাকি ১০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
২৩, ২৪ ও ২৫ জুলাই রোগীর সংখ্যা ১০ এর নিচে নেমে আসে। এই তিন দিনে যথাক্রমে ৫, ৮ ও ৮ জন করে রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে।
ফলে মাত্র আট দিনে চিকিৎসা নিতে আসা মোট ৪৪১ জনের মধ্যে ৬৯ শতাংশ মানুষ বা ৩০৬ জনের চোখের অপারেশন করে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।
বর্তমানে হাসপাতালটিতে মাত্র ১৫ জনকে ভর্তি অবস্থায় চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছেন। তবে অপারেশনকৃত রোগীদের সপ্তাহান্তে নিয়মিত ফলোআপ চিকিৎসা নিতে হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা।
শনিবার (২৭ জুলাই) দুপুরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জরুরি বিভাগের দুজন চিকিৎসক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিগত ৮ দিনে গুলিবিদ্ধ ও ইটপাটকেলে আহত রোগীদের সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল যন্ত্রণাদায়ক। এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতি ইতোপূর্বে মোকাবেলার অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না।
প্রথম দিকে হিমশিম খেলেও সকল ডাক্তার ও নার্স মিলে যথাযথ ব্যবস্থাপনায় মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী কারও কারও চোখে একাধিকবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। রোগীদের ভর্তি করে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পর্যাপ্ত বেড না থাকায় অধিকাংশ রোগীকে ২৩ জুলাইয়ের মধ্যেই ডিসচার্য দিয়ে দেওয়া হয়। এরমধ্যে অনেকেই ফলোআপ চিকিৎসা গ্রহণ করবেন বলে জানান তারা।
দুই চিকিৎসক আরও জানান, আহতদের একটি বিরাট অংশ দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখানে আসছেন। এরমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে এসেছেন বেশি। আর আহতদের বেশিরভাগই শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক এবং শিক্ষার্থী।
আহতদের একজন আবিদ ইসলাম, পড়তেন মোহাম্মাদপুরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাসপাতালে আবিদ ইসলামের বড়ভাই রাকিব হাসান বলেন, "শুক্রবার (১৯ জুলাই) আবিদ তার বন্ধুদের সাথে রাস্তায় গিয়েছিল। হঠাৎ করে বাম চোখের পাশঘেঁষে গুলি লেগে বের হয়ে যায়। প্রথমে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে একদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর চোখে ঝাপসা দেখায় ডাক্তাররা এখানে আসার পরামর্শ দেন।"
রাকিব আরও বলেন, "একটি অপারেশন করে ডাক্তার দুইদিন পর্যবেক্ষণ করেন, যে চোখ রাখা যাবে কি না। পরে, সোমবার আবারও অপারেশন করলে এক চোখ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এখন প্রায় ২ মাস বাসায় থেকে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে বলেছেন ডাক্তাররা।"
আরেকজন আহত কলিমউদ্দিন (৪২) কাজ করতেন উত্তরার আজমপুরে নির্মাণাধীন একটি ভবনে দিনমজুর হিসেবে। শনিবার বিকেলে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে বিপরীত দিক থেকে পুলিশের গুলি ডান চোখে লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যে পথচারীরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাতেই চক্ষুবিজ্ঞানে নিয়ে আসা হয় কলিমউদ্দিনকে।
গত মঙ্গলবার অপারেশন হলেও স্ত্রীসহ কলিমউদ্দিন আবারও এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। তিনি বলেন, "কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার চোখে গুলি লাগে। আমার পরিবারের মানুষকে খবর দেওয়ার আগেই আমার এক চোখ নাই। আমার ৪ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাবো, এটাই এখন চিন্তার বিষয়।"
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা জানান, "বিগত ৮ দিনে আমাদের ১১টি অস্ত্রোপচার কক্ষে (ওটি) ৬০ জনের ডাক্তার ও নার্সদের টিম রাতদিন ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে এসব অপারেশন সফল করেছেন।"
"এসময় তিন-চারদিন অধিকাংশ ডাক্তার-নার্সকে হাসপাতালেই রাত কাটাতে হয়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে রোগীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি," যোগ করেন তিনি।