শ্রীপুরে গুজব ছড়িয়ে বিজিবি সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ, হাজারো ব্যক্তির নামে মামলা
গাজীপুরের শ্রীপুরে বিজিবি সদস্যদের বিএসএফ বলে গুজব ছড়িয়ে এক বিজিবি সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা, বিজিবি সদস্যদের বহনকারী ১১গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আজ শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন।
তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার বিজিবি'র ময়মনসিংহ সেক্টর সদর দপ্তরের নায়েব সুবেদার সোহেল রানা বাদী হয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
নিহত বিজিবি সদস্যর নাম আব্দুল আলীম শেখ। তিনি বিজিবির ময়মনসিংহ সেক্টর সদর দপ্তরে নায়েক কর্মরত ছিলেন।
মামলায় হত্যার অভিযোগের পাশাপাশি ১১টি গাড়ি ভাঙচুর এবং পুড়িয়ে প্রায় ৪ কোটি ১২১ লাখ ৯০ হাজার টাকার সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করার অভিযোগ করা হয়েছে।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট সকাল ৮টায় বিজিবির ময়মনসিংহ সেক্টর সদর দপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক গাজীপুর শিল্প এলাকায় নিরাপত্তা বিধানের জন্য ২টি পিকআপ ও ৮টি বেসামরিক বাসযোগে ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি) হতে বিজিবি সদস্যরা কনভয় আকারে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। পথিমধ্যে ময়শনসিংহের ত্রিশাল, ভালুকাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে তারা বাধার মুখে পড়ে। বিজিবি সদস্যরা আলোচনার মাধ্যমে কাটিয়ে সকাল ১০টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে গাজীপুরের মাওনা ফ্লাইওভার (মাওনা চৌরাস্তা) সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছালে বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়।
মাওনায় বিজিবি সদস্যরা পৌঁছানোর পূর্বেই ওই এলাকায় কয়েকটি বেসামরিক যানবাহন পোড়ানো ও ভাঙচুর করা হয়। ফলে চলাচলের জন্য রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যায়। রাস্তা চলাচলের জন্য সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় এবং হাজার হাজার জনতা রাস্তায় অবস্থান করায় কনভয়টি ধীরগতিতে চলতে থাকে। এসময় বিজিবি সদস্য বহনকারী ২টি বেসামরিক বাস এবং ১টি পিকআপ কনভয় থেকে বিছিন্ন হয়ে পিছনে পড়ে।
এজাহারে আরও বলা হয়, এসময় স্থানীয়দের মাঝে বিজিবি সদস্যদের নিয়ে গুজবের সৃষ্টি হয় যে, উক্ত কনভয়ে ভারতের 'বিএসএফ (র) এর এজেন্ট বিজিবি'র পোশাক পরে ছদ্মবেশে) ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে রাস্তায় অবস্থানকারীরা উক্ত বাস দুইটির গতিরোধ করে 'বিএসএফ' বলে চিৎকার করতে থাকে। তখন কয়েকজন স্থানীয় লোক ক্ষিপ্ত হয়ে বাসে উঠে পড়ে এবং বিজিবি সদস্যদের 'ভারতীয় বিএসএফ' এবং 'র' এর এজেন্ট বলে গালিগালাজ করতে থাকে। বাসে উপস্থিত বিজিবি সদস্যরা তাদেরকে বারবার পরিচয় নিশ্চিত করাসহ প্রত্যেকের আইডি কার্ড দেখান। বিজিবি'র কথায় কোনো রকম কর্ণপাত না করে তারা বাস দুটিকে পেট্রোল পাম্পের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা বাসের চাকার হাওয়া ছেড়ে দেয়। পরে বিক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে কয়েকজন ইন্ধন দিয়ে বাসের ভিতর অবস্থানকারী বিজিবি সদস্যদের পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাসের গায়ে পেট্রোল ঢালতে থাকে এবং বাসের ভেলের ট্যাংকি ছিন্ন করে দেয়। তারা অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে লাঠিসোটা দিয়ে প্রহার করতে থাকে।
চারিদিক থেকে তখন আরও হাজার হাজার মানুষ আসে এবং মুহুর্মুহু ইট পাটকেল, ককটেল, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। ইতোমধ্যে বিক্ষুব্ধ জনতা নায়েক মো. আব্দুল আলীম শেখ সহ ১০/১২ জনকে গুরুতর আহত করে এবং নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে যেতে থাকে। তখন জান-মালের হেফাজতের জন্য আত্মরক্ষার্থে তারা ফাঁকা গুলি করে।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, এই খবর পেয়ে সামনে পিকআপে থাকা দলটি আমাদেরকে উদ্ধারের জন্য পিকআপ নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে পিকআপে থাকা দলটি উত্তেজিত জনতার রোষানলে পড়ে। ফলে দলটি আমাদের কাছাকাছি এসেও উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় এবং এক সময় দলটি পিকআপ ছেড়ে দৌঁড়ে গ্রামের ভিতরে এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন বিক্ষুব্ধ জনতা ছেড়ে যাওয়া পিকআপটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
ওইদিন বিকাল ৩টার দিকে গাজীপুর ব্যাটালিয়ন (৬৩ বিজিবি) থেকে আরেকটি দল ২টি এপিসি সহকারে অবরুদ্ধ বিজিবি সদস্যদের উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এপিসিগুলো ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে স্থানীয়দের শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এসময় বিক্ষুব্ধ জনতা বিজিবি সদস্যদের বহনকারী বাসে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করলে বিজিবি সদস্যরা নিজের জীবন বাঁচাতে বাসের বাইরে নেমে আসে। এসময় এপিসি দুটিসহ অন্যস্থানে চলে যায়। পরে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ময়মনসিংহ থেকে আরও একটি দল, সেনাবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার বিজিবির সদস্যদের উদ্ধার করতে গেলে হামলাকারীরারা হেলিকপ্টার লক্ষ করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর দুজন ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে আসলে তাদের ওপরও হামলা করে।
সেনাবাহিনী ও বিজিবির উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে থেকে বিজিবি সদস্যদের কৌশলে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সময় মাওনা চৌরাস্তা এলাকা থেকে গড়গড়িয়া মাস্টার বাড়ি পর্যন্ত হামলা ও ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে বিক্ষুব্ধ জনতা।
এ সময় কয়েকজন বিজিবি সদস্য স্থানীয় একটি মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নিলে সেখানেও তাদের ওপর হামলা চালিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। অনেকেই মসজিদের জানালার গ্লাস ভেঙে খালি গায়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। এ সময় নায়ক আব্দুল আলিম শেখ নামে এক বিজিবি সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হামলাকারীরা বিজিবির একটি জিপ, ৬টি পিক-আপ, ৩টি ট্রাক, ১টি ম্যাজিস্ট্রেট বহনকারী পিক-আপ ও দুটি বাস ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেয়।
পরবর্তীতে নায়েক মো. আব্দুল আলীম শেখ এর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে দাফন করা হয়।
এই ঘটনার জেরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতি, ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের হিসাব নিকাশ, নিহত/আহত সদস্যদের সঠিক হিসাব নিরুপণের কারণে এবং আমাদের ঊর্ধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও অনুমতি নিয়ে থানায় এজাহার দায়ের করিতে বিলম্ব হলো।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন বলেন, 'বিজিবির একজন সদস্য বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। অজ্ঞাতনামা আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হবে।'