যেভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের হাতছাড়া হয় পতেঙ্গা টার্মিনালের পরিচালনা কার্যক্রম
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) নিজস্ব তহবিল থেকে ১,২৩০ কোটি টাকায় নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতায় আরও পাঁচ লাখ টিইইউ [টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট] যুক্ত করার কথা ছিল।
টার্মিনালটি দুই বছরেরও বেশি সময় আগে নির্মাণ করা হলেও এটির বিদেশি অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) সরঞ্জামের অভাবে টার্মিনালের সক্ষমতার মাত্র ৮ শতাংশেরও কম ব্যবহার করতে পেরেছে। ফলে বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশিত রিটার্নের চেয়ে অনেক কম রিটার্ন এসেছে এবং ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সীমিত আয়
বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিটি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং থেকে মাত্র ১৮ ডলার আয় করে, যা চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যান্য টার্মিনালগুলোর চার্জ করা ৮০-৯০ ডলারের তুলনায় অনেক কম। তাই প্রশ্ন জাগে, পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ও সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর কেন একটি বিদেশি অপারেটরের কাছে গেল।
সৌদি আরবভিত্তিক অপারেটরটি ছয়মাসে কেবল আংশিক অপারেশন শুরু করতে পেরেছে। পতেঙ্গা টার্মিনালের দৈনিক ১,৩৬৯ টিইইউ পরিচালনা করার সক্ষমতার বিপরীতে এটি প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১৭৮ টিইইউ পরিচালনা করতে পেরেছে বলে জানা গেছে। এ বছরের জুনে অপারেশন শুরু হওয়ার পর থেকে চার মাসের কর্মক্ষমতার ব্রিফ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কলকাঠি নেড়েছিল আওয়ামী লীগের 'প্রভাবশালীরা'
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ব্যবস্থার অধীনে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে 'ইকুইপ, অপারেট অ্যান্ড মেন্টেইন' চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার অনেক আগেই বন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মকর্তা এমন চুক্তির বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত টার্মিনালে একটি বিদেশি অপারেটর নিযুক্ত করার অর্থ বন্দরের সরাসরি ১,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারানো এবং বিদেশি সংস্থাটি পুরোদমে কাজ চালু করতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত প্রায় দুই বছরের বিলম্বের কারণে ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া।
এসব সতর্কতা উপেক্ষা করা হয়েছিল। এক পর্যায়ে বন্দর চেয়ারম্যানকে পরিবর্তন করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি 'প্রভাবশালী মহলের' আপ্রাণ চেষ্টার ফলে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। সরকারি নথিপত্র ও সাবেক শীর্ষ বন্দর কর্মকর্তাদের মন্তব্য থেকে এসব ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে।
বড় খরচ ছাড়াই লাভ?
বন্দর ব্যবহারকারীরা পিসিটির দুর্বল পারফরম্যান্সের জন্য অপারেটরের পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সরঞ্জামের অভাবকে দায়ী করেছেন, কারণ বন্দরটিকে সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত করতে দুই বছর সময়ের দরকার।
পিসিটি নন-গিয়ারড জাহাজ পরিচালনা করতে পারে না, কারণ অপারেটর কোম্পানির কাছে জাহাজ থেকে কন্টেইনার আনলোড করার জন্য ক্রেনের মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। স্ক্যানার না থাকায় এটি আমদানিকৃত পণ্যও হ্যান্ডেল করতে পারছে না।
শুল্ক বিধি অনুসারে, ৩৮টি সুনির্দিষ্ট আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই সব কন্টেইনার অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপোতে পাঠানোর আগে স্ক্যান বা শারীরিকভাবে পরীক্ষা করতে হবে। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সমস্ত আমদানি চালান ম্যানুয়ালি পরীক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেন পিসিটির কার্যক্রম কেবল কয়েকটি রপ্তানি কন্টেইনার পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, 'বিনিয়োগকারী আরএসজিটিআই-এর স্ক্যানার নেই, তাই এটি আমদানি পণ্য পরিচালনা করতে পারছে না। চুক্তি স্বাক্ষরের নয় মাস পরও তারা পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমে যেতে পারেনি।'
তিনি আরও বলেন, 'বন্দর চালু হলে লাভ আসবে, আমরা ব্যবসায়ীরা লাভবান হব। কিন্তু এখন আমরা কোনো সুবিধা পাচ্ছি না।'
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আরএসজিটিআই-এর ১,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা ছিল, যার ৭০ শতাংশ ঋণের মাধ্যমে আসত। ইতোমধ্যেই এটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে ঋণ চেয়েছে।
টার্মিনালের কার্যক্রম সৌদি কোম্পানিটির কাছে হস্তান্তর করা হয় মাত্র ২২০ কোটি টাকার একটি অগ্রিম ছাড় ফি হিসেবে, যা পতেঙ্গা টার্মিনালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মোট বিনিয়োগের মাত্র ৯ শতাংশ। জমির মূল্য ও উন্নয়ন ব্যয়সহ জেটি নির্মাণের খরচ যোগ করলে যার মোট পরিমাণ দাঁড়াবে ২,৫০০ কোটি টাকা।
সাবেক সিপিএ চেয়ারম্যান এম শাহজাহান এবং অন্য দুই সিপিএ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আরএসজিটিআই উল্লেখযোগ্য অগ্রিম বিনিয়োগ ছাড়াই লাভবান হচ্ছে। তাদের দাবি, সংস্থাটি সরঞ্জাম কেনার জন্য পিসিটির আয় ব্যবহার করছে।
তবে, আরএসজিটি বাংলাদেশের সিইও এরউইন হ্যাজকে টিবিএস-এর পাঠানো এক ইমেইলের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির যোগাযোগ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, 'আরএসজিটি বাংলাদেশে ৪০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করেছে। আগামী দুই বছরে আমরা টার্মিনালের সরঞ্জাম ও অবকাঠামো আরও আধুনিকীকরণে অতিরিক্ত ১৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছি।'
বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী টিবিএসকে জানান, 'বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা না দিয়ে স্থানীয় বা বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে নিজেই টার্মিনাল পরিচালনা করত, তাহলে বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেত এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই থাকত।'
তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
যেভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতছাড়া হলো পতেঙ্গা টার্মিনাল
২০১৯ সালের ৩১ জুলাই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। প্রাথমিকভাবে চুক্তিটি জিটুজিভিত্তিক (সরকার-থেকে-সরকার) পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলের অধীনে হওয়ার কথা ছিল।
তবে, ২০২২ সালের ৭ জুন যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পিপিপি প্রকল্পগুলো সাধারণত যেখানে কোনো অবকাঠামো বিদ্যমান নেই, এমন 'গ্রিনফিল্ড' সাইটের জন্য করা হয়। তবে পিসিটি একটি 'গ্রেফিল্ড' সাইটে নির্মিত হয়েছিল, যেখানে সিপিএ ইতোমধ্যেই টার্মিনালের নির্মাণ সম্পন্ন করেছে।
২০২২ সালের জুলাই মাসে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরপরই সিপিএ পতেঙ্গা টার্মিনালের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে বছরের নভেম্বরে মায়ানমার থেকে চালবোঝাই জাহাজের বার্থিং এবং পরের বছর জানুয়ারিতে আরেকটি জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে সফল ট্রায়াল অপারেশন অনুষ্ঠিত হয়। এটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালটি নিজস্ব পরিচালনার সক্ষমতার প্রমাণ দেয়।
কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পতেঙ্গা টার্মিনালের জন্য একটি বিদেশি অপারেটর নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে টার্মিনালের কার্যক্রম ২২ বছরের জন্য আরএসজিটিআই-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
চুক্তিটি বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য একটি বিস্ময়কর পদক্ষেপ ছিল। কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল এবং এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
তখন বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা পতেঙ্গা টার্মিনালটি নিজেই পরিচালনা করতে সক্ষম এবং প্রতিদিন বৈদেশিক মুদ্রায় ১.৬ কোটি টাকা আয় করতে পারবে। টার্মিনালের তিনটি বার্থে কন্টেইনার পরিচালনা করে এক বছরে তা ৫৪৬ কোটি টাকায় পরিণত করা সম্ভব।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রস্তুত করা একটি ব্রিফে বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য প্রায় ৪৬০ কোটি টাকার সরঞ্জাম কিনতে হতো, যা টার্মিনালের এক বছরের আয় থেকেই ফেরত পাওয়া যেত।
ব্রিফটিতে আরও পরামর্শ দেওয়া হয়, যদি কোনো বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি করতেই হয়, তাহলে বন্দর কর্তৃক ইতোমধ্যে নিয়োগকৃত বার্থ অপারেটরদের একটিকে এ কাজে রাখা যেতে পারে, যারা বন্দরের সরঞ্জাম ব্যবহার করে এবং কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের রাজস্ব শেয়ার করে।
তৎকালীন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠিতে (যেটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দেখেছে) এ ধরনের চুক্তিতে বন্দর ও দেশের সম্ভাব্য ক্ষতির কথা উল্লেখ করেন।
এক সপ্তাহের মধ্যেই শাহজাহানের স্থলাভিষিক্ত হন রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহেল। তিনি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আরএসজিটিআই চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার সময় বন্দরের চেয়ারম্যান ছিলেন।
প্রভাবে চুক্তি স্বাক্ষরিত?
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কথা বলতে শুরু করেছেন, যদিও অনেকেই এখনও নাম প্রকাশ করে কথা বলতে ইচ্ছুক নন। এমনকি বন্দর কর্তৃপক্ষের লেনদেন উপদেষ্টা আইএফসি-এর একজন সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা ১২ আগস্ট একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে জানান, তিনি দেশের স্বার্থের ক্ষতি করবে মনে করা চুক্তিটির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলায় তাকে 'এজেন্সির দক্ষিণ এশীয় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল'।
এ সপ্তাহে টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে শাহজাহান বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিদেশি কোম্পানির কাছে টার্মিনাল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে 'প্রভাব' বিস্তার করেছিলেন, যার ফলে কার্যক্রম শুরু করতে দুই বছরের বিলম্ব হয়েছে।
বন্দরের আরেক সাবেক কর্মকর্তাও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। আট বছর বন্দরে দায়িত্ব পালন করা এবং এমওইউ স্বাক্ষরের সঙ্গে জড়িত থাকা সাবেক সিপিএ সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, 'আমাদের দুর্ভাগ্য যে সমস্ত অবকাঠামো নির্মাণের পরেও পিসিটি পরিচালনার জন্য আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে চুক্তি করতে হলো। আমরা আরএসজিটিআই নয়, আরএসজিটি-র সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর করেছি। আরএসজিটিআই কীভাবে দৃশ্যপটে এল?'
হারানো রাজস্ব
কিছু সিপিএ কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, পতেঙ্গা টার্মিনালের ইজারা চুক্তি দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সৌদি কোম্পানিকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছে।
যেমন, সিপিএ বর্তমানে বন্দর টার্মিনালে পরিচালিত প্রতি টিইইউ কন্টেইনার থেকে ৮০ থেকে ৯০ মার্কিন ডলার আয় করে। এটি বার্থ এবং টার্মিনাল অপারেটরদের ৮ থেকে ১০ মার্কিন ডলার দেয়। তবে পতেঙ্গা টার্মিনালে আরএসজিটিআই সিপিএ-কে প্রতি টিইইউতে মাত্র ১৮ ডলার দেবে।
এছাড়া সিপিএ বছরে প্রথম ২.৫ লাখ টিইইউ পরিচালনার জন্য শুধু এই ১৮ ডলার পাবে, যদিও টার্মিনালটির বছরে পাঁচ লক্ষ টিইইউ পরিচালনা করার সক্ষমতা রয়েছে। এই সীমার বাইরে অতিরিক্ত টিইইউ পরিচালনা করলে, সিপিএ প্রতি টিইইউ ট্যারিফের মাত্র অর্ধেক পাবে।
পাশাপাশি, সিপিএ উদ্বৃত্ত রাজস্বের মাত্র ৩০ শতাংশ পাবে, আর আরএসজিটিআই পাবে ৭০ শতাংশ।
'আমাদের ট্যারিফ কাঠামো সিপিএ ট্যারিফ বইয়ের প্রকাশিত হার অনুযায়ী কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। ছাড় চুক্তির সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো গোপনীয় থাকলেও, আমরা আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি যে, এর শর্তাবলী বৈশ্বিক শিল্পমান মেনে চলে,' এক ইমেইলে দাবি করেছে কোম্পানিটি।
'এই শর্তাবলীর মধ্যে অগ্রিম অর্থপ্রদান, নির্দিষ্ট মাসিক অর্থপ্রদান, মাসিক রয়্যালটি ফি, ন্যূনতম ভলিউম গ্যারান্টি, সংশ্লিষ্ট জরিমানাসহ মূল কর্মক্ষমতা সূচক এবং রাজস্ব ভাগাভাগি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে,' ইমেইলে আরও উল্লেখ করা হয়।
আইএফসি-এর স্বার্থের সংঘাত
বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতের ঋণদানকারী সংস্থা আইএফসি-এর ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে সিপিএ-এর বে টার্মিনাল প্রকল্পের উন্নয়নের জন্য পিএসএ সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ করার কথা ছিল।
পিএসএ সিঙ্গাপুর আইএফসি থেকে তহবিল নেবে বলে একাধিক মিডিয়া ইভেন্টে দুই সাবেক সিপিএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহেল এবং এম শাহজাহান বলেছিলেন।
শাহজাহান আরও বলেন, পিপিপি কর্তৃপক্ষ পিসিটি-র জন্য ব্যবসায়িক মডেল গঠন এবং আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে ছাড় চুক্তি প্রণয়নের জন্য আইএফসি-কে লেনদেন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করতে চাইলে সিপিএ ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল, কারণ নির্দেশিকা প্রণয়নকারী সত্তাটিও ছিল একটি বিনিয়োগকারী।
তিনি বলেন, যেহেতু পিসিটি সিপিএ-এর জন্য বেঞ্চমার্ক ছাড় চুক্তি হিসেবে কাজ করবে, তাই এই চুক্তির শর্তগুলো ভবিষ্যতের বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ি ডিপ সি টার্মিনালের মতো প্রকল্পের জন্য রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
হুইসেলব্লোয়ারের সতর্কতা
সাবেক আইএফসি কর্মকর্তা সুমায়া মাহমুদ ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া দলে বিনিয়োগ বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি চুক্তির খসড়া তৈরিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি, এ কর্মকর্তা বেশ কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, চুক্তিটি আরএসজিটিআইকে সুবিধা দিয়ে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করেছে।
১২ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বড় পোস্টে তিনি লেখেন, 'যেভাবেই হোক প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার জন্য এবং ডিউ ডিলিজেন্সের সঙ্গে আপস করতে আমাদের ওপর চরম অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।'
পরে টিবিএস-এর সাথে কথা বলার সময় সুমায়া দাবি করেন, তিনি আইএফসি-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে রিপোর্ট করেছেন। কিন্তু তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
আইএফসি-এর কমিউনিকেশন অ্যান্ড আউটরিচ ডিরেক্টর স্টিভেন কে শালিতা সুমায়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চেয়ে টিবিএস-এর পাঠানো ইমেলের জবাব দেন।
স্টিভেন জানান, আইএফসি চট্টগ্রাম বন্দরকে রাজস্ব ভাগাভাগির মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে চুক্তির খসড়া তৈরিতে সহায়তা করেছে এবং বন্দর খাতে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছে।
তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, আইএফসি সাবেক ও বর্তমান উভয় ধরনের কর্মকর্তার অভিযোগকে গুরুত্ব সহকারে নেয় এবং এই জাতীয় বিষয়গুলোর ন্যায্য সমাধান নিশ্চিত করার জন্য কঠোর অভ্যন্তরীণ নীতিমালা অনুসরণ করে।
চুক্তির পক্ষে সিপিএ
সিপিএ-এর বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামানকে ৮ সেপ্টেম্বর চুক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে সংস্থাটি প্রাথমিকভাবে লিখিত প্রতিক্রিয়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
তবে, ৩০ সেপ্টেম্বর সিপিএ সেক্রেটারি মোহাম্মদ ওমর ফারুক এক বার্তায় টিবিএসকে বলেন, চুক্তিটি সিপিএ বা দেশের স্বার্থের কোনো ক্ষতি করেনি।
তিনি বলেন, 'চুক্তিটি শুল্ক হার, নিরাপত্তা এবং মেরিন পরিষেবা সহ সিপিএ-কে প্রায় সমস্ত নিয়ন্ত্রণের অনুমতি দেয়, যা এটিকে জমির মালিক হিসেবে আর্থিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে।'
সৌদি কোম্পানি যত কন্টেইনারই হ্যান্ডেল করুক না কেন, সিপিএ কমপক্ষে আড়াই লাখ টিইইউ-এর ভিত্তিতে ট্যারিফ পাবে বলে ওমর ফারুক জানান।
চট্টগ্রাম বন্দর আর কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই আগামী ২২ বছর ভালো পরিমাণ অর্থ উপার্জনের আশা করছে। 'বন্দর কেবল ট্যারিফ শেয়ার থেকে চুক্তির মেয়াদে আরএসজিটিআই থেকে তাদের বিনিয়োগের কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ গুণ পাবে। এছাড়া, বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা টার্মিনালটি পরিচালনা করবেন, যা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় নিশ্চিত করবে,' তিনি আরও বলেন।
তাছাড়া সৌদি আরব ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রযুক্তি আদান-প্রদানের মাধ্যমে এটি বিশ্বের আধুনিক বন্দরের সঙ্গে সিপিএ-এর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াবে বলে উল্লেখ করেন সিপিএ সেক্রেটারি।