পুনর্মূল্যায়নের পর এমআরটি-৫ প্রকল্পের ব্যয় কমল প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা
১৭.২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল এমআরটি-৫ (গাবতলী-দাশেরকান্দি) সাউদার্ন রুট প্রকল্পের ব্যয় সাম্প্রতিক পর্যালোচনার পর ১৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। এর মাধ্যমে আগের সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে ব্যয় সাশ্রয়ের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রকল্পটি পুনর্মূল্যায়নের পর প্রায় ছয় হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা ব্যয় কমিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশে এ পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিস্তারিত নকশা সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের খরচ কমানো হয়েছে।
সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে আরও খরচ হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুল ওহাব জানান, ঋণের সুদ পরিশোধের সময় কমিয়ে আনা, মূলধন ব্যয় হ্রাস এবং অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলন কমানোর মাধ্যমে খরচ সাশ্রয় করা হয়েছে।
ডিএমটিসিএল-এর কর্মকর্তারা জানান, সড়ক পরিবহন বিভাগ এবং পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের পর্যালোচনার পর প্রকল্পের ব্যয় আরও কমতে পারে।
প্রাথমিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিএমটিসিএল প্রকল্পটির জন্য ৫৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করলেও তখন ব্যয়ে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে ডিএমটিসিএল প্রকল্পটি পুনর্বিবেচিত হয় এবং ব্যয় ৪৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকায় সংশোধিত হয়।
প্রথম পর্যালোচনার পর ডিএমটিসিএল সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে জমা দেয়।
বিভাগে পাঠানো ডিএমটিসিএল-এর এক চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের প্রেক্ষাপট ও ব্যয় বিশ্লেষণ, ইউনিট রেট, বৈদেশিক ঋণের সুদ এবং সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ব্যয় কমানো হয়েছে।
ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মোট ব্যয়ের মধ্যে ৩৯ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা বিদেশি ঋণের আওতায় থাকবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং দক্ষিণ কোরিয়া এ অর্থায়নে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে।
এমআরটি-৫ দক্ষিণ রুটটি গাবতলী, টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদ গেট, রাসেল স্কয়ার, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, আফতাবনগর, নাসিরাবাদ এবং দাশেরকান্দি এলাকাগুলোকে সংযুক্ত করবে।
এমআরটি-৫ প্রকল্পে গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত ১৩.১০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ এবং আফতাবনগর থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ৪.১০ কিলোমিটার উঁচু মেট্রো লাইন তৈরি করার কথা রয়েছে।
যেভাবে খরচ কমানো হয়েছে
এমআরটি-৫ প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুল ওহাব টিবিএসকে জানান, সংশোধিত ব্যয় প্রাক্কলন এখনো চূড়ান্ত নয়, কারণ এটি পরিকল্পনা বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি বলেন, ঋণের সুদ পরিশোধের সময়কাল পুনর্গঠনের মাধ্যমে আনুমানিক খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে।
'প্রথমে আমরা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঋণের সুদ হিসাব করেছিলাম। কিন্তু এখন প্রকল্পের মেয়াদের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে সুদের সময়সীমা নির্ধারণ করেছি। এর ফলে চার হাজার ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে — এতে মোট সুদ সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা থেকে কমে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে,' তিনি বলেন।
'এছাড়া কিছু বাড়িয়ে করা প্রাক্কলন চিহ্নিত হওয়ার পর খরচ কমানো হয়েছে। তাছাড়া, বিস্তারিত নকশা ও প্রকৃত বাজারমূল্যের ভিত্তিতে মূলধন ব্যয় পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে,' উল্লেখ করেন প্রকল্প পরিচালক।
আবদুল ওহাব আরও বলেন, 'সাধারণত প্রাথমিক প্রাক্কলনে ভবিষ্যতের যেকোনো ধরনের সমন্বয়-ব্যয় মেটানোর জন্য অতিরিক্ত উপকরণ বিবেচনায় থাকে। কিন্তু এখন আমাদের হাতে বিশদ নকশা থাকায় সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমাদের স্পষ্ট ধারণা রয়েছে, যা অতিরিক্ত খরচ এড়াতে সহায়ক হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকলে খরচ আরও কমে আসতে পারে। তবে ডলারের দাম বাড়লে ব্যয় ৮০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।'
'প্রকল্প অনুমোদনে যথাযথ যাচাই-বাছাই প্রয়োজন'
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক টিবিএসকে বলেন, আগের সরকারের সময় প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের অভাব ছিল, যার ফলে ব্যয় প্রাক্কলন নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন তোলা হয়নি।
তিনি বলেন, 'কেউ প্রশ্ন করেনি কেন অমুক ব্যয় এত বেশি ধরা হয়েছে। এ ধরনের প্রশ্ন না করার কারণে সম্ভবত প্রকল্প অনুমোদনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও কোনোভাবে উপকৃত হচ্ছিলেন, যার ফলে প্রকল্পের খরচ স্ফীত হয়েছে।'
অধ্যাপক হক আরও উল্লেখ করেন, 'বর্তমান প্রকল্প কর্তৃপক্ষ স্ব-প্রণোদিতভাবে যে-সব ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়েছে, তা ইঙ্গিত করে যে, বড় আকারের প্রকল্পগুলোতে এখনও স্ফীত ব্যয়ের প্রবণতা বিদ্যমান।'
তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে গত ১৫ বছরের মধ্যে সমস্ত চলমান এবং আসন্ন প্রকল্প পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'এ সময়ে ব্যয় বৃদ্ধির একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যার ফলে আমাদের নির্মাণ খরচ ইউরোপের তুলনায় বেশি হয়ে গেছে। এটি মূলত জবাবদিহিতার অভাবের কারণে ঘটেছে।'
এ অধ্যাপক আরও বলেন, এ প্রবণতা পরিবর্তনের জন্য সরকারকে অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে কেন খরচ এত বেশি ধরা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
পুরান ঢাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে এমআরটি-৫-এর বিকল্প ভাবছে সরকার
পরিকল্পনা কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য কি না তা মূল্যায়নের জন্য আরও পর্যালোচনা করা হবে।
যদিও এমআরটি-৫-এর খরচ কমানো হয়েছে, জানা গেছে যে সরকার প্রকল্পের বিকল্প হিসেবে পুরান ঢাকাকে মেট্রো নেটওয়ার্কের আওতায় আনার চিন্তা করছে। কিন্তু এমআরটি-৫ সাউদার্ন রুটের বর্তমান পরিকল্পনায় পুরান ঢাকাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবে, এমআরটি লাইন-২ (গাবতলী-সদরঘাট-নারায়ণগঞ্জ)-এর আওতায় পুরান ঢাকা অন্তর্ভুক্ত এবং এটিকে এমআরটি-৫ (দক্ষিণ রুট)-এর বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যদি এমআরটি লাইন-২ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটি পুরান ঢাকাকে গাবতলীর মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত করবে।
অন্যদিকে, বাণিজ্যিক উন্নয়ন মূলত এমআরটি-৫ এর শেষ পয়েন্ট দাশেরকান্দি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক বিবেচনায় কমিশন এমআরটি-২ কে এমআরটি-৫-এর চেয়ে আরও গুরুত্ব দিচ্ছে।
এমআরটি লাইন-২-এর প্রধান রুটটি গাবতলী থেকে ঢাকা উদ্যান, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নিউমার্কেট, আজিমপুর, পলাশী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, গুলিস্তান, মতিঝিল, কমলাপুর, মান্ডা, দক্ষিণগাঁও, দামড়িপাড়া, সাইনবোর্ড, ভূইঘর, জালকুড়ি হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত।
এর একটি শাখা নয়াবাজার থেকে গুলিস্তান হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত যাবে, যদিও এ রুটের সম্ভাব্যতা এখনো যাচাই করা হয়নি।
ডিএমটিসিএল-এর মতে, ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি-২ লাইন নির্মাণে ৬০ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। তবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর চূড়ান্ত ব্যয় নির্ধারণ করা হবে।
এমআরটি-২ ছাড়াও কমিশন আরও কিছু বিকল্প নিয়ে ভাবছে। যেমন, কারওয়ান বাজার অংশটি এমআরটি-৫ (সাউদার্ন রুট) থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে। আরেকটি বিকল্প হচ্ছে বিজয় সরণিতে এমআরটি-২-এর একটি শাখা লাইন যুক্ত করা। দুটি প্রকল্পেরই শুরু গাবতলী থেকে।
আরেকটি বিকল্প হিসেবে কমিশন কেবল কারওয়ান বাজার থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত এমআরটি-৫ (সাউদার্ন রুট) নির্মাণের চিন্তা করছে।
অপর বিকল্প প্রস্তাবে এমআরটি সাউদার্ন রুট পুরো প্রকল্প আপাতত বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত হলে প্রকল্পটি পুনরায় বিবেচনা করা হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।