‘বিনিয়োগের জন্য সেরা সময় এখনই’
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)- এর নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছেন বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিনিধি। তিনি হলেন, চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
বিডা ও বেজার দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি এইচএসবিসির ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসাবে সিঙ্গাপুরে দায়িত্ব পালন করেছেন। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে পড়াশোনা করা চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন দীর্ঘদিন সাসটেইনেবল ফাইন্যান্সিং বা টেকসই অর্থায়ন নিয়ে কাজ করেছেন।
দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোসহ ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে তার পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের (টিবিএস) সঙ্গে। গত ৫ নভেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিনিয়োগ ভবনে চৌধুরী আশিক মাহমুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টিবিএসের চিফ রিপোর্টার আব্বাস উদ্দিন নয়ন এবং স্টাফ করেসপন্ডেন্ট জহির রায়হান।
বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যেগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিডা ও বেজায় সংস্কারের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?
সংস্কারের বিষয়ে আমি মনে করি, ডিজিটালাইজেশন ঠিকভাবে হলে সেবার মান উন্নয়ন হবে অনেক।
আমাদের প্রচলিত চিন্তা হলো যে, বিনিয়োগকারীরা আমার কাছে দায়বন্ধ। আসলে ব্যাপারটা উল্টো।
তিনি (বিনিয়োগকারী) আমার জিডিপি গ্রোথ উন্নয়ন করবেন, অর্থনীতি টেনে তুলবেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন— ফলে সরকার তার কাছে দায়বদ্ধ, আমি তার কাছে দায়বন্ধ। এই মানসিকতা রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। আমাদের কর্মকর্তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে এ বিষয়ে উন্নয়নের পরিকল্পনা করেছি। কীভাবে ক্লাইন্টদের সঙ্গে কথা বলতে হবে– সে বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। কী কী ধরনের সার্ভিস সেবাগ্রহীতারা আশা করেন, সেটি আরও ভালোভাবে জানতে হবে।
আমাদের পরিকল্পনা হলো, আমাদের নিজস্ব বিনিয়োগকারীদের খুশি করে তাদের দ্বারাই বিদেশি বিনোয়াগ নিয়ে আসা। তারা অ্যাম্বাসেডর হবেন। আমরা বিদেশে রোড শো করার পক্ষপাতি না, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং আমাদর বিনিয়োগকারীদের দ্বারা বিদেশি বিনিয়োগ আনবো। আমরা সামসাং এর মতো কয়েকটা বড় বিনিয়োগকারীকে এনে তাদের দ্বারা নতুন নতুন দ্বার উম্মোচন করতে চাই।
বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের টেইলরড সলিউশন নিয়ে যেতে হবে। তাদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে বলবো যে, আলাদা বিশেষ সুবিধা আমরা দিতে পারি। অ্যাঙ্কর বিনিয়োগকারীর কাছে গিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। সরকারিভাবে তাদের সঙ্গে বাইলেটারাল (দ্বিপাক্ষিক) আলোচনা করতে হবে। এটা আগামী জানুয়ারি থেকে হবে। আমাদের সংস্কারের জায়গা এটাই।
আমরা সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে চাই। কোনো ঘুষ–দুর্নীতি থাকবে না। ওপেন ডোর পলিসি হবে। আর এটাই হবে আমাদের সংস্কার।
আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কি?
আমি দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম যে কাজটি করেছি তা হলো, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে তাদের কথা শুনেছি। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আমি অন্তত ২০০ প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে বৈঠক করেছি।
একটি বিষয় পরিস্কার যে, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী কমিটির চ্যলেঞ্জগুলো আমাদের শুনতে হবে। প্রথমে শুনতে হবে, এরপর সেটা সমাধান করতে হবে।
এরজন্য আমরা একটি কমন ডায়লগের প্ল্যাটফর্ম করছি। অতীতে যেটা হয়ে আসছিল যে, একজন ব্যক্তির মাধ্যমে সব হতো। ফলে যারা এক্সেস পেতেন না, তারা ছিটকে যেতেন। আমরা এটা পরিবর্তন করেছি। আমরা সবার কথা শুনছি।
ব্যবসায়ীরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন?
ব্যবসায়ীদের কমন কথা হলো, ব্যবসা–বাণিজ্যে প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। এটা নিয়ে সবার উদ্বেগ রয়েছে। পলিসির ধারাবাহিকতা ধরে রাখার কথাও বলেছেন তারা। ব্যবাসীদের যে সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আমরা দেই, সেটা আমাদের সঠিক সময়ে দিতে হবে।
বেজা'তে কেউ জমি নিয়েছেন, তাকে বললাম আপনাকে ২০২৬ সালে বিদ্যুৎ দেব। সেটা যদি ২০২৮ সালেও এসে না দিতে পারি, তাহলে তো তার জন্য ব্যবসা পরিকল্পনা করা কঠিন হবে। বিনিয়োগ করে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এই সমস্যাগুলোই বেশি এসেছে। এছাড়া, ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের বিভিন্ন খাত নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের উদ্বেগ জানিয়েছেন।
'ইজ অব ডুয়িং বিজনেস' এবং ব্যবসা পরিবেশ নিয়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি; এটি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি?
ইজ অব ডুইং বিজনেস-এ উন্নয়নে আমরা কয়েকটি অংশে কাজ করছি। বাংলাদেশে কারখানা করতে অনেক লাইসেন্স বা সনদের প্রয়োজন হয়। আসলে এতগুলো লাইসেন্সের প্রয়োজন আছে কি-না— এ বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। যে দেশগুলো এ বিষয়ে সফল, তাদের কাছ থেকে ভালো অভিজ্ঞতা নেব। তাদের সঙ্গে তুলনা করে দেখবো, একই ধরনের প্রতিষ্ঠান সেখানে তৈরি করতে কতগুলো সনদের প্রয়োজন হয়। ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া কীভাবে সেবা দেয়। তাদের যে সনদ নিতে হয়, সেটি বাংলাদেশে প্রয়োজন আছে কিনা তা দেখবো; যদি প্রয়োজন থাকে, তাহলে কেন এখানে এত জটিলতা তা বের করা হবে; এরপরে আমরা এটির সমাধান করবো।
প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়ে আমরা একটি টিম তৈরি করেছি— যারা লাইসেন্সিং নিয়ে কাজ করছে। প্রত্যেকটি শিল্পর লাইসেন্স ভিন্ন। আমরা প্রথমে দুইটি প্রায়োরটি সেক্টর নিয়ে কাজ করবো। এরপর ধাপে ধাপে এগোবো।
শিল্প ধরে ধরে সমস্যার সমাধান করবো। লাইসেন্সের বিষয়ে যে টিম কাজ করবে, তাদের প্রধান কাজ হবে সমস্যা চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী কাজ করা। এটা হলো 'ইজ অব ডুইং বিজনেস' উন্নয়ন করার একটি পার্ট।
ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সিং সহজ করতে 'ওয়ান স্টপ সার্ভিস' চালু করা হয়েছে, এটির এখন কী অবস্থা?
কয়েক বছর আগেই ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। তবে এটি কার্যকর নয়। কেন নয়, সেটির উত্তর না দিয়ে সমাধানের কথা বলি আমরা।
লাইসেন্স বা বিভিন্ন অনুমোতি পেতে ব্যবসায়ীকে এখনো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে আবার কোথাও আটকে যায়। এটা সমাধানে আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস পুরোপুরি চালু করবো। আমাদের কোঅর্ডিনেশন মিটিং হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার অফিসে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিডা এই প্রজেক্ট চালাবে। বিডার পক্ষ থেকে সত্যিকারের ওয়ান স্টপ সার্ভিস যাকে বলে সেটাই চালু করবো।
কেউ বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলতে আসলে একজনের সঙ্গে, এক জায়গাতেই কথা বলে সব সমাধান পাবেন। ফোকাল পার্সন সব মন্ত্রণালয়ে কথা বলে, সকল প্রয়োজনীয় তথ্য বিনিয়োগকারীকে দেবেন। একটা 'রিসিপশন রুম কনসেপ' তৈরি করতে চাচ্ছি। আপনি রুমে ঢুকলেন, আপনি সেখানে বসে রইলেন, বাকি লোক এসে যেখানে যোগাযোগ করতে হয়– যোগযোগ করে আপনার কাজ সমাধান করে দেবে। আপনাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হবে না।
এটার জন্য আমরা টিম গঠন করবো। আমরা বিডার অধীনে একটি রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট টিম তৈরি করছি। কিছু সরকারি অফিসার থাকবেন এখানে, তবে বেশিরভাগ থাকবেন বেসরকারি খাতের লোক— যাদের কাজ হচ্ছে সমস্যা সমাধান করা।
বিনিয়োগকারীরা বন্দর, সাপ্লাই চেইন নিয়ে নানান সমস্যার কথা বলেন। ঢাকা, চট্টগ্রামে পণ্য যেতে সময় লাগে। বন্দরে পণ্য খালাসে সময় বেশি লাগে। আপনি বেসরকারি খাতে কাজ করেছেন, এটা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
বন্দরের ব্যাপারে সমাধান যদি গ্রাউন্ডলেভেলে এক্সিকিউশন করতে পারি, তাহলে আমার ধারণা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে।
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সহজ করতে 'ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো' এর বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা ফেব্রুয়ারি শেষে এটা চালু করার কথা বলেছে। এটা চালু হলে বিল পরিশোধ ডিজিটাল হবে। এর মাধ্যমে বেশিরভাগ সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে।
অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) জানুয়ারি থেকে গ্রাইন্ডলেভেলে কাজ শুরু করবে। এটাতে পোর্ট পারফরমেন্স ভালো হবে।
বন্দরে আমদানি-রপ্তানি সহজ করতে একটি মানসম্মত আধুনিক কনটেইনার টার্মিনাল চট্টগ্রামের লালদিয়া চরে হচ্ছে। এটা নিয়ে কাজ করতে ডেনমার্কভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিপিং কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। বে টার্মিনাল প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে সিঙ্গাপুর। এগুলো কার্যকর হলে বন্দরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে।
বিগত সরকারের ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা ছিল, আপনারা এটা নিয়ে কী ভাবছেন? কতগুলো বাস্তবায়নযোগ্য?
অর্থনৈতিক অঞ্চল আমরা ৩ ভাগে ভাগে করি। একটি হলো, প্রাইভেট (বেসরকারি) অর্থনৈতিক অঞ্চল— যেটা আমরা নিজেরা উন্নয়ন করি না; আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইউটিলিটি সার্ভিস দোরগোড়ায় দেই, সংযোগ রাস্তা করে দেই। তারাই এটা উন্নয়ন করে।
দ্বিতীয়টি হলো, জি-টু-জি অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটার উন্নয়নও ওই দেশই করে। আমরা তাদের ইউটিলিটি সাপোর্ট-সহ সংযোগ রাস্তা করে দেই। এ অর্থনৈতিক অঞ্চল তারা তাদের মতো করে করবে।
তবে সরকার যে অর্থনৈতিক অঞ্চল নিজে করছে, মানে সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল, এগুলোয় আমরা আগামী ৫ বছরে কী করবো এর একটি রোডম্যাপ করেছি।
যেমন— চট্টগ্রামের মিরসরাইতে প্রায় ৩০টি সাব-জোন আছে। তার মধ্যে আমরা হয়তো ৪-৫টি সাব-জোন নিয়ে কাজ করবো। সেখানে আমরা সম্পূর্ণ সংযোগ ও সব ধরনের সাপোর্ট দিতে চাই। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও রাস্তা-সহ প্রয়োজনীয় সব সুবিধা দেওয়া হবে।
আর চট্টগ্রামের বাইরে আগামী ৫ বছরে অমরা অল্প কয়েকটি জোন নিয়ে কাজ করবো।
২০৪০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকবে।
গ্যাসের অভাবে কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কিছু ফ্যাক্টরি উৎপাদনে যেতে পারছে না। এটা সমাধানে কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি?
যারা ফ্যাক্টরি করে রেখেছেন, সেখানে যেন দ্রুত গ্যাস সংযোগ পান, সে বিষয়ে বেজা সকল পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করছে।
আমাদের জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী, গ্যাসের সরবরাহে প্রায় ২৫ শতাংশ ঘাটতি আছে। আমাদের গ্যাস সবরাহের যে পাইলাইন, সেটিও অনেক পুরোনো। সার্বিকভাবে বললে, দেশের গ্যাসের যে চাহিদা, সেটা রাতারাতি পূরণ করা সম্ভব নয়। একটু মসয় লাগবে।
তবে আমরা চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে আমরা গ্যাসের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করেই অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করবো।
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে?
আমি শুরুতেই রোড শো করার বিরোধীতা করেছি। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে বিভিন্ন দেশে আমাদের অ্যাম্বাসেডর (রাষ্ট্রদূত), ইকোনমিক কাউন্সিল বড় সোর্স হতে পারে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েকটি দেশের অ্যাম্বাসেডর তাদের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হিসাবে আমার সাথে দেখা করেছেন। কোরিয়ার অ্যাম্বাসেডর গত এক মাসে চার বার দেখা করেছেন। আমরা চাই আমাদের মিশন, অ্যাম্বাসেডররাও তাই করুক।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
আমি মনে করি, দেশে বিনিয়োগের সেরা সময় এখনই। কারণ এই সরকারে যারা আছেন, কেউই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আসেননি। কেউ কারো স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবসায়ীদের ঘোরাবেন না। ৬ মাস আগেও এই কারণে কোনো ব্যবসা শুরু করতে হলে ভাবতে হতো— এই খাতে কোন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ব্যবসা করেন; কাকে কাকে খুশি করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু এখন এইসব ভাবনা নেই।
তাই আসুন, বিনিয়োগ করুন।