ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মধ্যেই বাড়ছে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ
দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই বেড়ে চলেছে চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সে বছর ঢাকায় মাত্র সাড়ে ৪ মাসের মধ্যে ১৩,৮০০ জনের বেশি রোগী হাসপাতালে চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
এ বছর এখন পর্যন্ত ৬৭ জন চিকুনগুনিয়া এবং ১১ জন জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজিএইচএস) অধ্যাপক মো. আবু জাফর।
"শনাক্ত হওয়া চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্তদের বেশিরভাগই ঢাকার বাসিন্দা। প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে গিয়ে এই রোগীদের শনাক্ত করা হয়েছে," বলেন ডা. আবু জাফর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য ছাড়াও, চিকুনগুনিয়া ও এ ধরনের রোগে আক্রান্তদের বিভিন্ন বিশেষায়িত ক্লিনিক এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে দেখা যাচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গত মাসে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ এর বেশি চিকুনগুনিয়া রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে; একই সময়ে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৩০০ এর বেশি রোগীকে।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডা. আশরাফুল ইসলাম ইরফান টিবিএসকে বলেন, "আমরা এখন ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়া রোগী বেশি পাচ্ছি। গিরায় প্রচণ্ড ব্যথা, এরজন্য বসতে না পারা–উঠতে না পারা, জ্বরসহ বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে রোগীরা আসছেন। কারো কারো আবার শরীরে র্যাশও দেখা যাচ্ছে।"
"চিকুনগুনিয়া হলে সাধারণত ৭ দিনের মধ্যে ব্যথা কমে যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় মাস, এমনকি ৬ মাস পর্যন্ত গিরায় ব্যথা থাকে। চিকুনগুনিয়া রোগীদের পেইন কিলার (ব্যথানাশক) দেওয়া হয়। এ বছর যেহেতু সিজন শেষ, আগামী বছর চিকুনগুনিয়া আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে," যোগ করেন ডা. আশরাফুল ইসলাম।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের ওপর হওয়া এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় আক্রান্তদের ৯৫ শতাংশই শয্যাশায়ী ছিলেন। প্রায় ৮৩ শতাংশ রোগীর জীবনযাত্রার নিম্ন থেকে অতিনিম্ন মানে পৌঁছেছিল এবং প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী গিরায় গুরুতর ব্যথার কারণে ১০ দিনের বেশি উৎপাদনশীলতা হারিয়েছিলেন।
আগামী বছর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব নিয়ে শঙ্কা
আগামী বছর দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর বিজ্ঞানী ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া মোকাবেলায় এসিশ মশা নিয়ন্ত্রণের তাগিদ তাদের।
চলতি বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার ২৭টি কেস শনাক্ত করেছে আইসিডিডিআর,বি। ডেঙ্গু হয়নি, এমন রোগীদের স্যাম্পল পরীক্ষা করে চিকুনগুনিয়া পাওয়া গেছে।
আইসিডিডিআর,বি-এর সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম টিবিএসকে বলেন, আগামী বছর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব হওয়ায় প্রবল সম্ভাবনা আছে।
"২০১৭ সালে দেশে চিকুনগুনিয়ার বড় আউটব্রেক (প্রাদুর্ভাব) হয়েছিল। তার আগে ২০০৮ সাল থেকে একটু একটু করে ঢাকার বাইরে, ২০১৪-২০১৫ সালে ঢাকার আশেপাশে চিকুনগুনিয়া পাওয়া গেছে। এ বছর ঢাকায় অনেক পাওয়া যাচ্ছে। সিজন শেষ তাই আগামী বছর একটা বড় আউটব্রেক হওয়ার সম্ভাবনা আছে," যোগ করেন তিনি।
ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম আরও বলেন, "জিকা, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু— সবই একই ভেক্টর দিয়ে ছড়ায়, সেটি হলো এডিস। ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী করতে হবে। আর এটাকে শক্তিশালী করতে হলে সিটি করপোরেশনগুলোকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে, যেটি তার করছে না। কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করলে তিনটি রোগই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সে উপায়ে কাজ করতে হবে। আমাদের শত্রু একটাই, মশা, সেটিকে দমন করতে হবে।"
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকার মতো মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হল মশা নিধন। যেহেতু রোগগুলো এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তাই মশা নিধনে আমাদের আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এডিস মশা নির্মূল করার জন্য আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার, যার অভাবেই মূলত বর্তমানে এই সংক্রমণ বাড়ছে।"
চিকুনগুনিয়ার পাশাপাশি দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। কেবল এ বছরেই দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৯৩ হাজারের বেশি এবং মারা গেছেন প্রায় ৫০০ জন।
সিটি কর্পোরেশনের প্রচেষ্টা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির টিবিএসকে বলেন, "চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। আমরা এডিস, কিউলেক্সসহ অন্যান্য সব ধরনের মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চিকুনগুনিয়া রোগীরা দীর্ঘদিন ধরে ভুগলেও, এ রোগ মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য। তারপরও আমরা এ বিষয়ে সচেতন রয়েছি।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার এবং সরকারী সংস্থার কাছ থেকে ইনপুট (তথ্য-পরামর্শ) নিয়ে বছরব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা তৈরি করে থাকি। আমরা এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নিই।"
শামসুল কবির বলেন, "আগামী বছরের মশা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য কয়েকদিনের মধ্যেই বৈঠক করব। আইসিডিডিআর,বি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আইইডিসিআর এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেবেন। আমরা এ বছরের অভিজ্ঞতা ও ভুলগুলোও বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী কর্মসূচি আরও উন্নত করব।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের মশা নিধন কর্মসূচি সারাবছর চলে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিকুনগুনিয়ার ব্যাপরে তথ্য পাওয়া গেলে, আমরা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেব। মশা নিধনে আমরা প্রতিবছর একটি নতুন পরিকল্পনা তৈরি করি, যার মধ্যে এটিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "যেসব এলাকায় এডিস মশা প্রজনন করে সেখানে আমরা মশা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালাই এবং মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি।"
"আমাদের লক্ষ্য, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ যাতে মারা না যান, তা নিশ্চিত করা," যোগ করেন তিনি।