মোদি-ট্রাম্প বৈঠকের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/14/hpq6yrvxrjiprncel6v5zitj3i.jpg)
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম ওয়াশিংটন সফর ছিল মূলত ব্যবসাকেন্দ্রিক। তাই স্বাভাবিকভাবেই এটি আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফরের আড়ম্বর থেকে মুক্ত ছিল। খবর বিবিসি'র।
ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ২০২৫ সাল থেকে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানসহ আরও সামরিক সরঞ্জাম কিনবে। পাশাপাশি বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি বাড়াবে। এছাড়া, দুই দেশ একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে এবং নতুন প্রতিরক্ষা কাঠামো চূড়ান্ত করতে সম্মত হয়েছে।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, এখনো মাত্র এক মাসেরও কম সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
তবে সামনে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ট্রাম্প-মোদি বৈঠকের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে বিবিসি।
ভারত কি পাল্টা শুল্ক এড়াতে পেরেছে?
মোদির সফরের সময় ট্রাম্প নির্দেশ দেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদারদের 'পাল্টা শুল্ক' গুণতে হবে। অর্থাৎ, আমেরিকান পণ্যের ওপর যে শুল্ক ধার্য করা হয়, সেই অনুপাতে যুক্তরাষ্ট্রও সেই দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করবে। তিনি তার উপদেষ্টাদের নতুন শুল্ক কাঠামো প্রস্তুত করতে বলেছেন, যা ১ এপ্রিলের মধ্যে কার্যকর হতে পারে।
বর্তমানে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যে ভারতের উদ্বৃত্ত রয়েছে। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির প্রভাব এড়াতে ভারত সাম্প্রতিক বাজেটে গড় শুল্ক হার ১৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ শতাংশ করেছে। তবে এই পদক্ষেপে ভারত আসলেই শুল্ক চাপ এড়াতে পারবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, এই মুহূর্তে ভারতের জন্য বড় কোনো শুল্ক সংকট দেখা দেবে না।
তবে ভারতের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থার সাবেক প্রধান অভিজিৎ দাস বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী নন। তার মতে, 'সমস্যার আসল জায়গা লুকিয়ে থাকে খুঁটিনাটিতে। এই শুল্ক শুধু আমদানি শুল্কের প্রতিফলন হবে না, এতে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হতে পারে।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি শুধু আমদানি শুল্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার এবং বিভিন্ন বাণিজ্য বিধিনিষেধ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ভারতের আমদানি পণ্যের ওপর আরোপিত পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও ট্রাম্প এটিকে তার শুল্ক নীতির স্বপক্ষে ব্যবহার করতে পারেন।
অভিজিৎ দাস মনে করেন, এটি ভারতের স্থানীয় উৎপাদনকারীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে এবং 'মেক ইন ইন্ডিয়া' উদ্যোগের ওপর সরাসরি চাপ ফেলবে। তার মতে, 'এটি ভারতের জন্য ভালো খবর নয়।'
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল শুল্ক আরোপ করে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব নয়। প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি খাতে বড় আকারের কেনাকাটার মাধ্যমে এই ঘাটতি কিছুটা কমানো যেতে পারে।
২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন-ভারত বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা ৫০০ বিলিয়ন ডলার
নতুন বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১৯০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণের মার্কিন-ভারত বাণিজ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি ২০২৫ সালের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তির প্রথম পর্যায় নিয়ে আলোচনা শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই আলোচনায় মূলত বাজারে প্রবেশাধিকার, শুল্ক হ্রাস এবং পণ্য ও পরিষেবা সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, 'বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার ঘোষণা ভারতের জন্য শুল্ক হ্রাসের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এটি শুধু মার্কিন-ভারত সম্পর্ক নয়, বরং সাম্প্রতিক সময়ে দুর্বল হয়ে পড়া ভারতীয় অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক।'
তবে এই চুক্তির প্রকৃতি এখনও স্পষ্ট নয়।
অভিজিৎ দাস বলেন, 'এই চুক্তির বিস্তারিত জানতে অপেক্ষা করতে হবে। এটি যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি তা-ই হতো, তাহলে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকত। এটি নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের শুল্ক হ্রাস সংক্রান্ত পারস্পরিক সমঝোতা হতে পারে।'
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেন, যুক্তরাষ্ট্র শিগগিরই ভারতের শীর্ষ তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী হয়ে উঠবে।
প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা ও যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বাণিজ্য প্রায় শূন্য থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে।
প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও গভীর করতে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আগামী বছর থেকেই ভারতের কাছে বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি বাড়াবে। এর ফলে এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান সরবরাহের পথও উন্মুক্ত হবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে না।
কুগেলম্যান মন্তব্য করেন, 'এটি শুনতে ভালো লাগলেও বাস্তবে কার্যকর করা কঠিন হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বাড়লেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কারণে স্পর্শকাতর প্রযুক্তির হস্তান্তর বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন প্রতিরক্ষা কাঠামো হয়তো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে।'
ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লার মতে, ভারত 'এফ-৩৫ কেনার প্রস্তাবকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে না', কারণ এ যুদ্ধবিমানের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অত্যন্ত বেশি।
মোদি-মাস্ক বৈঠক: টেসলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
মোদি টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উদীয়মান প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তবে এই বৈঠকে মাস্কের স্টারলিংক পরিষেবা ভারতে চালু হওয়া বা টেসলার বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
মাস্ক সরাসরি স্পেকট্রাম বরাদ্দ চেয়েছেন। অন্যদিকে ভারতীয় বিলিয়নিয়ার মুকেশ আম্বানির পছন্দ নিলামের মাধ্যমে বরাদ্দ। এদিকে মাস্কের লাইসেন্স এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ভারত টেসলাকে দেশীয় উৎপাদন কারখানা স্থাপনের শর্তে বৈদ্যুতিক যান আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এর জন্য কোম্পানিকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে এবং তিন বছরের মধ্যে দেশেই উৎপাদন শুরু করতে হবে। টেসলা এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়নি।
বিরল এক মুহূর্ত: মোদির সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের উত্তর
মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে দুটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন—একটি অবৈধ অভিবাসন ও অপরটি আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে মার্কিন বিচার বিভাগের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে।
তিনি জানান, ট্রাম্পের সঙ্গে আদানি প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে অভিবাসন প্রসঙ্গে বলেন, ভারত যাচাই করা অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত।
প্রসঙ্গত, প্রায় ১১ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদে এটি মাত্র তৃতীয়বারের মতো মোদির সাংবাদিকদের সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। তিনি কখনোই একক কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি।