টোল, ট্যাক্স, ফি থেকে আসবে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের খরচ
বাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল কিংবা অটোরিকশা, ট্রাকসহ সব ধরণের মোটরযানে ব্যবহৃত পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, সিএনজি বা এলএনজিসহ যেকোন জ্বালানির মূল্য থেকে প্রতি লিটার ও ঘনমিটারে ১ টাকা করে আদায় করবে সরকার।
এ অর্থ মহাসড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কারে ব্যয় হবে।
'সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বোর্ড বিধিমালা-২০২১' এর খসড়ায় সড়কপথে চলাচলকারী মোটরযানে ব্যবহৃত জ্বালানীর মূল্য হতে এভাবে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ আদায়ের প্রস্তাব করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
এ বিভাগের উপসচিব ফারজানা জেসমিন স্বাক্ষরিত খসড়াটি গত মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে আগামী ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মতামত পাঠাতে বলা হয়েছে, যার একটি কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও পেট্রোবাংলার বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোটরযানে ব্যবহৃত প্রতি লিটার জ্বালানি তেল এবং প্রতি ঘনমিটার সিএনজি ও এলএনজিতে ১ টাকা হারে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ আরোপ করা হলে মোটরযান মালিকদের দৈনিক বাড়তি গুনতে হবে ১৪ কোটি টাকারও বেশি, যা বছরে দাঁড়াবে প্রায় ৫২৭০ কোটি টাকা।
এর প্রভাবে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে যাত্রীদের, পণ্য পরিবহন ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে ডিজেলের দাম বাড়ার পর যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক যানবাহনে ব্যবহৃত কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসের পরিমাণ ১৩.৩৬ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ, এ খাত থেকে দৈনিক সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলে জমা হবে ১৩.৩৬ কোটি টাকা।
গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে যোগাযোগ খাতে ৩৯.৬৪ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করেছে বিপিসি। লিটারে ১ টাকা হারে চার্জ আরোপ হলে জ্বালানি তেল থেকে বছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ পাওয়া যাবে ৩৯৬ কোটি টাকা।
বর্তমানে সড়ক, মহাসড়ক ও সেতু মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিবছর বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সড়ক, মহাসড়ক ও সেতু মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ ছিল ২৬৮৭ কোটি টাকা, যার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয়েছে। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল গঠন হলে এখান থেকেই অর্থ ব্যয় করা হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৪৭,৭৬,৯৪৪টি। গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহনের বড় অংশই গ্যাসচালিত, অন্যদিকে ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহন ও মোটরসাইকেলগুলো তেলচালিত।
সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলে সড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহন নিবন্ধন ও চলাচলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সব ধরণের ফি, ট্যাক্স, আমদানি শুল্কও এ তহবিলে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাধীন সড়ক, সেতু ও ফেরি হতে আদায় করা টোলের শতভাগ এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের আদায় করা টোলের ২৫% এই তহবিলে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. শামসুল হক টিবিএসকে বলেন, ২০০০ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ই বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এই তহবিল গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তহবিলটি অর্থ মন্ত্রণালয় নাকি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা নিয়ে তৎকালীন দুই মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও নাজমুল হুদার মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে তা হয়নি।
২০১৩ সালে যখন আইন প্রণয়ন করা হয়, তখনই আলোচনা হয়েছিল যে, যেকোন স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২% তা রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ রাখতে হবে, তবে তা এখনও হয়নি। প্রকল্পের আওতায় নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ হচ্ছে, কিন্তু তার রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না।
'ডিজেল, সিএনজিসহ জ্বালানীর মূল্যের উপর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের চার্জ আরোপ করা এখনই যৌক্তিক হবে না। কারণ, বৈশ্বিকভাবেই জ্বালানির মূল্য পরিবর্তন হয়। ১০০ টাকায় ১ টাকা চার্জ দেওয়া আর ২০ টাকায় ১ টাকা চার্জ দেওয়ার অর্থ এক নয়, এর চাপ জনগণের উপর পড়বে', যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার মতে, বিআরটিএর সব ধরণের ফি ও কর, সব ধরণের টোল নিয়ে এই তহবিল গঠন করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে সরকার সব মহাসড়কগুলোতে টোল আরোপ করবে, তখন তহবিল অনেকটাই বড় হবে। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হলে, তখন বিকল্প উৎস খোঁজা যেতে পারে।
এ বিভাগের রক্ষণাবেক্ষণ শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, ২০১৩ সালে প্রণীত সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বোর্ড আইনের আওতায় এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যেই খসড়া নীতিমালাটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন শেষে গেজেট জারি করে কার্যকর করার পরিকল্পনা রয়েছে।
খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল ব্যবস্থাপনায় একটি বোর্ড গঠন করা হবে। বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয়ও এই তহবিল থেকে হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রতি অর্থবছরের শেষ ৩ মাসের মধ্যে পরের অর্থবছরের জন্য সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের প্রস্তাবিত কর্মসূচি বোর্ডে পাঠাবে।
বোর্ড অর্থবছরের প্রথম মাসে সভা করে প্রস্তাবিত কর্মসূচি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ করে তা অনুমোদন করবে। বোর্ডের অনুমোদিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অধিদপ্তরে পাঠানো হবে।
বাৎসরিক কর্মসূচি বাদেও জরুরি প্রয়োজনে বোর্ড সভার অনুমোদন সাপেক্ষে সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে যেকোন জরুরি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দিতে পারবে।
এই তহবিলের অর্থ তছরুপ হওয়ার বড় ধরণের আশঙ্কা প্রকাশ করে মো. শামসুল ইসলাম বলেন, ফ্লাইওভার ও সড়ক নির্মাণের মতো প্রকল্পগুলোতে তছরুপ হলেও সেগুলো নির্মাণ করতে হয়। কারণ, এসব দৃশ্যমান অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। কিন্তু সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ চোখে দেখা যাবে না। কোনকিছু না করেই প্রকল্প নিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ বেশি থাকবে।
'তাই সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কার্যক্রম স্বাধীনভাবে থার্ডপার্টির মাধ্যমে মূল্যায়ন করে রিটার্ন যাচাই করে এই তহবিল থেকে বিল দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে', যোগ করেন তিনি।