জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধির আগেই ব্যয় বেড়েছে প্রায় সব উৎপাদন খাতে
জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির আগেই পোশাক শিল্পের ৯০ শতাংশ উপখাতের স্থানীয় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় স্পিনিং কটন, সিল্ক, সিনথেটিক, জুট, হ্যান্ড লুম, ওয়্যারিং অ্যাপারেল, নিটওয়্যারসহ ১০টি উপখাতের ৯টির উৎপাদন ব্যয় ১-৫৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
বিবিএসের ডমেস্টিক্যালি প্রডিউসড ইন্ডাস্ট্রিয়াল গুডস ইনডেক্সের তথ্যানুযায়ী, স্পিনিং অ্যান্ড কটন টেক্সটাইল ফাইবারের উৎপাদন খরচই বেড়েছে ৫৬.২২ শতাংশ। টেক্সটাইলের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৩.৬২ শতাংশ।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএম) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলছেন, মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে সব খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
বাস্তবে বিবিএসের তথ্যের চেয়ে খরচ বেশি বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত এক বছরে তুলার দাম শতভাগের বেশি বেড়েছে। ফাইবারের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। প্রায় প্রতিটি কাঁচামালের দাম ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে সবারই উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
পোশাক শিল্পের মতোই দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতের প্রায় সব খাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির পরিসংখ্যান উঠে এসেছে বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৯টি খাতের মধ্যে মাত্র ৩৪টি খাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়েনি। ব্যয় বেড়েছে ৮৩.৭২ শতাংশ খাতে।
২০০৫ সালকে ভিত্তি বছর এবং প্রডাক্টশন কস্টকে ১০০ বিবেচনা করে ব্যয় বৃদ্ধির ওই ইনডেক্সটি করেছে বিবিএস। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, গত বছর সবচেয়ে বেশি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়া ট্যানারি এবং ফিনিশ লেদার খাতের বর্তমান প্রডাক্টশন কস্ট ইনডেক্স ২৪৮.৯৫। গত বছর এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৭১.২৩ শতাংশ। লেদার পণ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য উৎপাদনের ব্যয়ও বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।
ট্যানারি ও লেদারগুডস শিল্প মালিকরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে সব কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধি, সঠিক সময়ে কাঁচামাল আনতে না পারা ও শ্রমিক বসিয়ে রাখার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দীন আহমেদ মাহিন বলেন, "গত এক বছরে কেমিক্যালের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। তবে ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে শ্রমিক ও কারখানা বসিয়ে রাখার কারণে।"
তিনি বলেন, "রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য বিক্রি না থাকায় অনেক দিন কারখানা বন্ধ ছিল। তবে এ সময়ও কারখানার পরিচালন ব্যয় বহন করতে হয়েছে। শ্রমিকদের বেতনও দিয়েছি। ফলে ব্যয় হয়েছে, আয় হয় নি। এসবের ক্যালকুলেশনের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।"
লেদার প্রডাক্টের পরই উৎপাদন ব্যয় বেশি বেড়েছে ভেজিটেবল ওয়েলে। বিবিএসের তথ্যমতে, এই তেলে স্থানীয় উৎপাদকদের ব্যয় ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের এ তেলের উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকরাও।
ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশের ভোগ্যপণ্য ব্যবসার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বলেন, বিশ্ববাজারে সয়াবিন, সয়াসিডসহ সব ধরণের তেলবীজের দাম বেড়েছে। যোগাযোগ ব্যয় এবং শ্রমিকদের ব্যয়ও বেড়েছে। আর এ কারণেই উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।
তেলের পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের সব ইন্টারমিডিয়েট গুডসের উৎপাদন ব্যয়ও ৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। খাদ্য পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বেড়েছে ১২.৩৩ শতাংশ। ডেইরি বা দুগ্ধজাত পণ্যে ব্যয় বেড়েছে ১.১৩ শতাংশ। তবে চিনির উৎপাদন খরচ অপরিবর্তিত রয়েছে গেল বছরে। যদিও বাজারে চিনির দাম বেড়েছে এই সময়ে।
ভারী পণ্যের মধ্যে সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যয় বেড়েছে ৫ শতাংশ, বেসিক মেটালে ১৫.১২ শতাংশ, আয়রন অ্যান্ড স্টিল মিলসে ১১.৬৭ শতাংশ, মোটর ভেহিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড অ্যাসেম্বলিংয়ে ১১.১২ শতাংশ, ট্রান্সপোর্ট ম্যাটারিয়ালসে ৪-১০ শতাংশ এবং ফার্নিচারে ৪ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে।
অধিকাংশ পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও কিছু পণ্যে ব্যয় বাড়েনি বলেও জানিয়েছে বিবিএস। এর মধ্যে ইলেকট্রিক অ্যাপ্লায়েন্স, সিগারেট, প্লাস্টিক, পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট, ফার্টিলাইজার, মেলামাইন, ইলেকট্রিক ল্যাম্প, ফ্র্যাক্টাল বোর্ডসহ বেশ কিছু অপ্রচলিত পণ্য রয়েছে।
অবশ্য বিবিএসের এ প্রতিবেদনকে অসম্পূর্ণ দাবি করে সব খাতেই উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশের ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, "করোনাকালীন সময়ে বিক্রয় না থাকলেও শ্রমিকদের বেতন ও কারখানার খরচ মেটাতে হয়েছে উৎপাদকদের। বৈশ্বিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে।
দেশের অভ্যন্তরে পরিবহন খরচ বেড়েছে। ফলে সব খাতেই উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।"
বাজারে প্রভাব
বিবিএসের পরিসংখ্যানে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিকে টপকে গেছে বাজারে সব পণ্যের দাম। গত এক বছরে রড-সিমেন্ট, পোশাক-আশাক, তেল, চিনি, চাল-ডালসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামই বেড়েছে হু হু করে। কিছু কিছু পণ্যে দাম দ্বিগুণও হয়েছে এই সময়ের মধ্যে।
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৫০-৫২ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি টন রডের বর্তমান দাম ৭৮ হাজার টাকা। কনস্ট্রাকশনের এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির দাম এক বছরে বাজারে প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। প্রায় একই হারে বেড়েছে সিমেন্ট, ইট, বালু, পাথরসহ গৃহ নির্মাণ সামগ্রীর শতাধিক উপাদানের দাম।
সয়াবিন তেল গত বছর ১০০ টাকা থাকলেও এখন তা প্রতি লিটার কিনতে হচ্ছে ১৬০ টাকায়। টিসিবির বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, এক বছরের তুলনায় খোলা ও বোতলজাত সয়াবিনে খরচ বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় খোলা আটায় ১৭.২৪ শতাংশ এবং প্যাকেট আটায় খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ হারে বেড়েছে চিনি, ডাল, পাউরুটি, বিস্কুটসহ নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্য।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, "কাঁচামাল ও উৎপাদন খরচ যা বেড়েছে বাজারে দাম তারচেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। সরকার বাজারে সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ নিলে এমনটি হতো না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে ভর্তুকি দেয়া যায়।"
নতুন শঙ্কা জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি
সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় আরো বাড়িয়ে দেয়ার শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এর ফলে নতুন করে পণ্যের ব্যয় অন্তত ২০ শতাংশ হারে বাড়বে।
দেশের হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও খাদ্যপণ্য ব্যবসার অন্যতম প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএলের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রথমত, ফ্যাক্টরির উৎপাদন খরচ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, পরিবহন খরচ অন্তত ৩০ শতাংশ বাড়বে। তৃতীয়ত, সব ধরণের কাঁচামালের দাম বাড়বে। এবং চতুর্থত, বিক্রয় প্রতিনিধিদের খরচ বাড়বে।"
এসব কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যায় পড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, উৎপাদন ব্যয় হঠাৎ করেই ২০-২৫ শতাংশ বাড়বে। ফলে পণ্যের দামও বাড়াতে হবে।
ভোগ্যপণ্যের বাজারজাতকারীদেরও একই সমস্যায় পড়তে হবে বলে জানিয়েছেন সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিত সাহা।
তিনি বলেন, "কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেশি। নতুন করে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিতে সব কিছুর উৎপাদন ও বিপণন ব্যয় বাড়বে। টিকে থাকার জন্যই দাম বাড়াতে হবে ব্যবসায়ীদের।"