ফ্রম ফ্রান্স ফর ওয়ার
ষাটের দশকের শেষ দিক। হেনিংয়ের বয়স তখন মাত্র তেইশ বছর। প্যারিস থেকে মস্কো এলেন। তারপর ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ ধরে যাত্রা শুরু করলেন। মাঝে পড়ল তৈগা বন। রাশিয়ার সাইবেরিয়া ছাড়িয়ে আলাস্কা, কানাডা, স্ক্যান্ডিনেভিয়ারও অনেকখানি জায়গায় আছে এ বন। কেবল সাইবেরিয়ারই ৩৬০০ বর্গমাইল জুড়ে আছে তৈগা। এর মধ্যে আছে বৈকাল নামে হ্রদ। হেনিং কাঁপতে কাঁপতে ইরকুৎস্ক নামের এক জায়গায় থামলেন। বরফ হয়ে যাওয়া বৈকাল লেকের বেশ খানিকটা এবার হেঁটেই যেতে হবে। বরফের দেশ পার হয়ে হেনিং জাপান আর হংকংয়ে কিছুদিন থাকলেন। তারপর গেলেন ভিয়েতনাম। দেশটায় তখন যুদ্ধ চলছে। আমেরিকান সৈনিকদের সঙ্গে একইরকম পোশাক পরে তিনি রণাঙ্গনের ছবি তুলতেন।
এদিকে আগে থেকেই কিছুটা খবর তার কানে আসছিল। পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা স্বাধীনতা চাইছে। তারা ভোটেও পেয়েছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানিরা কিছুতেই তাদেরকে ন্যায্য অংশ বুঝিয়ে দিচ্ছে না। এর মধ্যে পাকিস্তানিরা ঘটাল গণহত্যা। একাত্তরের মার্চ মাস তখন। কোটি মানুষ হলো দেশান্তরি। তরুণ যুবারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকল। কয়েক জায়গায় প্রতিরোধও গড়ে তুলল। বাঙালি তখন একটি স্বাধীন দেশ রচনায় বিভোর। হেনিং মানে অ্যান ডি হেনিং চলে এলেন পূর্ব পাকিস্তানে।
এপ্রিল মাস। ট্রেনিং ক্যাম্প, দেশান্তর হওয়া, রণকৌশল ঠিক করা ইত্যাদির ছবি তুলতে থাকলেন। কিন্তু হানাদাররা তখন বিদেশি সাংবাদিকদের ব্যাপারে খুব সতর্ক। তাদের কেউ যেন পূর্ব পাকিস্তানে না থাকে, সেটিই চাওয়া হয়েছিল। কারণ, তাদের মাধ্যমে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের কথা ছড়িয়ে পড়বে সারাবিশ্বে।
হেনিংও বেশিদিন থাকতে পারেননি। ফিরে যান হংকং। সত্তরের শুরুর দিকটায় হংকংই তার আবাসস্থল হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তিনি ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলেন তখন। বিশেষ করে লাওস, থাইল্যান্ড আর বোর্নিওর আদিবাসীদের ছবি তুলছিলেন। চীন সাগর অতিক্রম করে ফিলিপাইনে যাবার সময় তোলেন বেদেদের (সি জিপসি) ছবি।
তিনি ভারতেরও অনেক ছবি তুলেছেন। সাদাকালো ছবি তুলতে পছন্দ করতেন। বিয়ে করেছিলেন ভারতীয় আলোকচিত্রী রঘুবীর সিংকে।
১৯৭২ সালে দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশে এসেছিলেন হেনিং। তার মনে আছে, কীভাবে লাল সবুজের পতাকা হাতে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, 'আমাদের স্বাধীন দেশে তোমাকে স্বাগতম।'
হেনিং সেসময় বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে বক্তব্য রাখছিলেন বঙ্গবন্ধু। হেনিং কিন্তু বুঝতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, তবে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন।
১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে হেনিং প্যারিসের ৩৮টি ব্রিজের ছবি তুলেছিলেন। আর ২০০৫ সালের এক পর্যায়ে তিনি ফরাসী নৌবাহিনীর একটি জাহাজে চড়ে বসেছিলেন। জাহাজটি তুলো হয়ে জিবুতি গিয়েছিল সুয়েজ খাল ধরে। মাঝপথে ওমানে থেমেছিলেন। দেশটির মানুষ, সংস্কৃতি, স্থাপত্যশৈলী আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তারপর ২০০৬ সাল থেকে তিনি নিবিড়ভাবে আরব উপদ্বীপের ছবি তুলতে শুরু করেন। এ পর্বে ইয়েমেনও তার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। মারাকেশে তিনি কাজ করেছেন ইসলাম ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের চর্চা নিয়ে। আরব উপদ্বীপ নিয়ে তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে মিউনিখ ও প্যারিসে। তার 'ব্রিজেস অব প্যারিস' প্রদর্শিত হয়েছে ইতালি, দুবাই, কাতার, বাহরাইন, ফিলিস্তিন, ওমান ও ফ্রান্সে।
আজ এত দিন পর আবার হেনিংয়ের কথা বলছি কারণ প্রথমবারের মতো তার তোলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালের ছবিগুলোর দেখা মিলছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গত ১০ ডিসেম্বর শুরু হওয়া তার প্রদর্শনীটির নাম 'উইটনেসিং হিস্ট্রি ইন দ্য মেকিং: বাংলাদেশ'। মোট ৩৮টি ছবি নিয়ে এ প্রদর্শনী। তার মধ্যে ২০টি যুদ্ধকালের, ১১টি বঙ্গবন্ধুর এবং বাকীগুলো হেনিংয়ের আর্কাইভ থেকে। সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই), সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। প্রদর্শনী উপলক্ষে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন হেনিং। কিন্তু করোনা পথ আটকেছে। তবে তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রদর্শনী চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।