সিলেটে হঠাৎ করেই পানির দাম দ্বিগুণ, নগরে ক্ষোভ
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) হঠাৎ করেই পানির দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ করায় সিলেটের নগরবাসী এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। গণশুনানি ছাড়াই পানির দাম বাড়ানোকে অন্যায্য বলছেন নগরবাসী। এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে প্রতিদিনই সিলেট নগরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করছেন তারা। এমনকি সিসিকের কাউন্সিলররাও অংশ নিচ্ছেন এসব কর্মসূচীতে।
নগরবাসীর এই ক্ষোভের কারণে বিপাকে পড়েছে সিসিক। নাগরিকদের ক্ষোভ আঁচ করতে পেরে সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর সিটি মেয়রের সাথে দেখা করে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুণর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন। মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও বিবৃতি দিয়ে পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।
এ অবস্থায় জরুরী সাধারণ সভা ডেকে পানির বিল বৃদ্ধির বিষয়টি পুণর্বিবেচনার কথা বলছেন সিসিক মেয়র।
প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা গেছে,বর্তমানে সিলেট নগরে পানির দৈনিক চাহিদা রয়েছে প্রায় ৮ কোটি লিটার। কিন্তু সিটি করপোরেশন প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে।
পানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নগরের কাজীটুলা এলাকার বাসিন্দা মিসবাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, "আমরা প্রয়োজন মতো পানি পাই না। বাইরে থেকে পানি কিনে ব্যবহার করতে হয়। তবু মাসে মাসে সিসিককে পানির বিল দিয়ে আসছি। পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলেও হঠাৎ করে পানির দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দিয়েছে সিসিক।"
তিনি বলেন, "করোনার কারণে এমনিতেই মানুষের আয় কমেছে। অপরদিকে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েছে। এ অবস্থায় পানির দাম বাড়িয়ে দেওয়া অমানবিক। এতে নিম্ন আয়ের মানুষেরা বিপাকে পড়বে।"
তবে সিসিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎসহ সবকিছুর দাম বাড়ায় পানির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। একারণে পানির দামও বাড়াতে হয়েছে।
সিসিকের পানি শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকবর জানান, প্রতি মাসে পানি উৎপাদন বাবদ সিটি করপোরেশনের গড়ে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা খরচ হয়। এর বিপরীতে গ্রাহকদের কাছ থেকে গড়ে প্রতি মাসে ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ টাকা আদায় হয়। আর পানি বাবদ বকেয়া পড়ে আছে ১২ থেকে ১৩ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, "পানির দাম বাড়ানোর ফলে যদি শতভাগ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা সম্ভব হয়, তাহলে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা সিটি করপোরেশনের কোষাগারে জমা হবে। এতে লোকসান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।"
সিসিক সূত্রে জানা যায়, গত ২১ জুন সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় মাসিক পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১ জুলাই থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর ২ সেপ্টেম্বর সিটি করপোরেশন গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানায়। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর অক্টোবর থেকে গ্রাহকদের বর্ধিত বিল প্রদান করতে শুরু করে সিসিক।
সিটি করপোরেশনের মাসিক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি মাসে আধা ইঞ্চি ব্যাসের লাইনের ক্ষেত্রে আবাসিক গ্রাহকদের ২০০ টাকার পরিবর্তে ৫০০ টাকা এবং বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ৪০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা বিল নির্ধারণ করা হয়। পৌনে এক ইঞ্চি ব্যাসের লাইনের ক্ষেত্রে আবাসিক গ্রাহকদের ৪০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা এবং বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি গ্রাহকদের ৭০০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এক ইঞ্চি ব্যাসের লাইনের ক্ষেত্রে আবাসিক ও সরকারি গ্রাহকদের জন্য ১ হাজার টাকার পরিবর্তে দেড় হাজার টাকা দিতে হবে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে ২ হাজার ২০০ টাকা, প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের ২ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সিসিকের পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর থেকেই নগরজুড়ে ক্ষোভ দেখা দেয়। এরপর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রতিদিনই মেয়র বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা।
বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) বিকেলেও সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সুরমা বয়েজ ক্লাব, সিলেট ফাউন্ডেশন, ওয়েব অব হিউম্যানিটি এল্যায়েন্স, ক্লিন সিটি, লুমিলাস সোশ্যাল সার্ভিস নামে কয়েকটি সংগঠনের আয়োজনে মানববন্ধন করা হয়। প্রতিদিনই নগরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হচ্ছে। এতে সিসিকের কাউন্সিলররাও সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখছেন।
পানির বিল বৃদ্ধির প্রতিবাদে কর্মসূচীতে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে সিসিকের ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ বলেন, "আমরা সিসিকের মাসিক সভা করেই পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু যেহেতু এই সিদ্ধান্তে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে তাই এটি পুণর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। নাগরিকদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েই আমি তাদের কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছি।"
এদিকে, গত সপ্তাহে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুণর্বিবেচনার দাবি নিয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সাথে দেখা করেন অন্তত ১০ জন কাউন্সিলর।
এসময় ২৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন মেয়রের উদ্যেশে বলেন, "পানির দাম দিগুণ করে ফেলায় নাগরিকদের চাপ বেড়েছে। তারা এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অনেক এলাকার বাসিন্দারা পানি পান না কিন্তু তাদের বিল দিতে হয়। তাই জরুরী ভিত্তিতে একটি সাধারণ সভা ডেকে এই সিদ্ধান্ত পুণর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।"
পানির দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়ে গত রোববার সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন সাক্ষরিত এই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, কারো সাথে পরামর্শ না করে ও গণশুনানি না করে হঠাৎ পানির বিল বর্ধিতকরণের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ও অমানবিক। করোনা মহামারিতে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে নাজুক সেখানে তাদের কথা বিবেচনা না করে পানির বিল বর্ধিতকরণের বিষয়টি জনবিরোধীও বটে।
এ প্রসঙ্গে সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পানির দাম না বাড়িয়ে বরং যে পরিমাণ টাকা গ্রাহকদের কাছে বকেয়া আছে, সেগুলো উত্তোলন করা দরকার। নাগরিকদের নামমাত্র মূল্যে পানি সরবরাহ করা উচিত।
জনগনের দাবির মুখে পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুণর্বিবেচনার কথা বলছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, "গত ১৫/১৬ বছরে আমরা কোনো ধরণের সেবার দামই বাড়াইনি। কিন্তু এই সময়ে বিদ্যুতের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। এতে পানির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অন্যান্য সিটি করপোরেশন এবং ওয়াশাও পানি দাম বাড়িয়েছে। ব্যয় সমন্বয় করতেই আমরা পানির দাম বাড়িয়েছিলাম।"
তিনি বলেন, যেহেতু এই সিদ্ধান্তে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে তাই অতি জরুরী ভিত্তিতে সাধারণ সভা ডেকে এটি পুণবির্বেচনা করা হবে।
"পানির দাম সহনশীল মাত্রায় নিয়ে আসার ব্যাপারে আমরা আলোচনা করবো। তবে যারা বিল বছরের পর বছর ধরে পরিশোধ করছেন না এবং অবৈধ লাইন ব্যবহার করছেন তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না," যোগ করেন তিনি।