এই পানি এত সস্তা নয়
উৎপাদনশীলতার ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো বিভিন্ন খাতে পানির ছায়ামূল্য নির্ধারণ করে দিল দেশ।
এক কেজি বাসমতি প্রিমিয়াম চাল বা এক জোড়া জিন্স তৈরিতে পানির লুকানো খরচ কত, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে এ থেকে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার পানিতে এই লুকানো খরচ আড়াই টাকা এবং শিল্প খাতে ১ হাজার ৮০০ টাকা।
এর অর্থ হলো, কৃষি খাত ২ দশমিক ৫ টাকা মূল্যের ফসল উৎপাদন করতে ১ ঘনমিটার পানি ব্যবহার করে, আর শিল্প খাতে একই পরিমাণ পানি ব্যবহার করে ১ হাজার ৮০০ টাকার পণ্য উৎপাদিত হয়।
মন্ত্রণালয়ের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নানাবিধ ব্যবহার ও পরিষেবার জন্য এই প্রাকৃতিক সম্পদের সুষম বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে পানির এই মূল্য নির্ধারণ। প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে দেশের নাজুক অবস্থার দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থার ফলে পানির নিরাপত্তা, সরবরাহ মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ওয়াটার রিসোর্সেস প্ল্যানিং অরগানাইজেশন-এর (ওয়ারপো) জন্য 'ডেভেলপিং অপারেশনাল শ্যাডো প্রাইসেস ফর ওয়াটার টু সাপোর্ট ইনফর্মড পলিসি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ডিসিশন মেকিং প্রসেস' শীর্ষক গবেষণা চালায় সেন্টার ফর সিইজিআইএস। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, কৃষিতে ব্যবহৃত পানির আনুমানিক ছায়ামূল্য প্রতি ঘনমিটারে ২ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৮ টাকা। মুহুরী সেচ প্রকল্পে এ খরচ ১৮ দশমিক ৭৮ টাকা পর্যন্ত ওঠে।
সারা বিশ্বে ধানখেতগুলোতে বছরে প্রায় ১ হাজার ৩৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ব্যবহার করা হয়। অলাভজনক সংস্থা ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্ক-এর তথ্য অনুসারে, এই পানি বৃষ্টি ও সেচের পানির মিশ্রণ।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উৎপাদনের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে শিল্প খাতে পানির আর্থিক মূল্য ব্যাপকভাবে কম-বেশি হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পানির খরচ সবচেয়ে বেশি—গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ঘনমিটার পানির খরচ ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা।
নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত পানির গড় খরচ প্রতি ঘনমিটারে ১৬৯ টাকা। খাদ্য ও পানীয় খাতে, নুডলসের প্রতি ঘনমিটার পানির ছায়ামূল্য ১৩২ টাকা এবং সিরিয়ালের পানির ছায়ামূল্য ২১২ টাকা।
রপ্তানি খাত সংরক্ষণ ও পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষভাবে পানি ব্যবহারের চেষ্টা করে বলে পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত পানির ছায়ামূল্য অন্যান্য শিল্প খাতের তুলনায় দৃশ্যত কম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক শিল্পে সংরক্ষণ খরচসহ পানির ছায়ামূল্য আনুমানিক ৭৭ দশমিক ৮৫ টাকা।
পৃথিবীতে মোট যে পরিমাণ পানি রয়েছে, তার প্রায় ২ শতাংশ স্বাদু পানি। এই পানির খুবই ছোট একটা অংশ তরল আকারে বৃষ্টিপাত হিসাবে জলাভূমি, নদী ও ভূগর্ভস্থ জলাশয়ে সঞ্চিত থাকে।
সেন্টার ফর সিইজিআইএস বলছে, এই সামান্য পরিমাণ পানির বণ্টনও অসম। ফলে ব্যবহারযোগ্য পানি পরিণত হচ্ছে দুর্লভ সম্পদে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় পানির মূল্য অন্তর্ভুক্ত করা উচিত
গবেষণা দল মন্তব্য করেছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে পানির ব্যবহারকে পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় রাখা হয় না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান অর্থনৈতিক খাতগুলোতে টেকসই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত এবং এই দুর্লভ প্রাকৃতিক সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে 'জনসাধারণের বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে পানির ছায়ামূল্যের ব্যবহারকে কীভাবে একীভূত করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়'।
এতে আরও বলা হয়, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১-এর মতো দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কৌশলগুলোতেও পানির মূল্য অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
তবে 'তড়িঘড়ি করে পানির আনুমানিক ছায়ামূল্য ব্যবহার করার' বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে সমীক্ষায়। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, প্রধান ইনপুট হিসেবে পানি ব্যবহার করে এমন প্রকল্পগুলোর তুলনামূলক সুবিধা বিশ্লেষণের পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য পরিকল্পনা কমিশন একটি পাইলট গবেষণা করতে পারে। পাইলট গবেষণা সম্পন্ন করার পর বর্তমানে সংশোধন করতে থাকা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের নির্দেশিকায় পানির মূল্য বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
গবেষণায় আরও বলা হয়, গৃহস্থালি, সেচ কিংবা শিল্প কাজে পানির দক্ষ ব্যবহার এবং অপচয় কমানো নিশ্চিত করার জন্য স্লোগান হওয়া উচিত 'প্রতিটি ফোঁটাই গুরুত্বপূর্ণ'। এতে বলা হয়, পানিকে মূল্য দেওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ, পানির চক্রাকার ব্যবহার, সেচের বিকল্প ভেজা ও শুকনো পদ্ধতি, ওয়াটার স্মার্ট নগর উন্নয়ন ও সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা।
পানির ব্যবহারে 'শূন্য বর্জ্য' স্থিতিতে পৌঁছাতে বিভিন্ন খাতের জন্য 'দূষণকারী জরিমানা' এবং 'ভলিউমেট্রিক পানির বরাদ্দ' নির্দেশিকা কার্যকর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সমীক্ষায়।
পানি ব্যবহারের ফুটপ্রিন্ট কমাচ্ছে ফ্যাশন শিল্প
ফ্যাশন শিল্পেই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি পানির ব্যবহার হয়। এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে, টেক্সটাইল শিল্প বছরে ৯ হাজার ৩০০ কিউবিক মিটার পানি ব্যবহার করে, যা দিয়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ অলিম্পিকের সুইমিং পুল ভরানো যাবে।
আইএফসি'র একটি গবেষণার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটি বলছে, বাংলাদেশের আরএমজি খাতে প্রতিদিন ৪১১ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হয়। প্রতি বছর গার্মেন্টস শিল্পের সুতা ও পোশাকে ডাইং ও ওয়াশের কাজে ব্যবহার হচ্ছে এক লাখ ৫০ হাজার কোটি লিটার পানি। এদেশের পোশাক কারখানায় এক কেজি পোশাকপণ্য ওয়াশে ২৫০ লিটার পানি ব্যবহার করা হয়, অথচ পুরো বিশ্বে এর পরিমাণ ৬০-৭০ লিটার।
পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে কীভাবে মাত্র দুই বছরে নারায়ণগঞ্জের ফকির অ্যাপারেলস ৭০ শতাংশ এবং গাজীপুরের মন্ডল ফ্যাব্রিকস ২৭ শতাংশ পানি ব্যবহার কমিয়েছে তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
আগে ফকির অ্যাপারেলসকে প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ টন কাপড় ওয়াশ ও ডাইয়ের জন্য ২৪ দশমিক ৯৬ কোটি লিটার পানি ব্যবহার করতে হতো। এখন প্রতিষ্ঠানটিকে পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে মাত্র ৬ দশমিক ৯৬ কোটি লিটার।
প্রতিকেজি কাপড়ে আগে ১২০ লিটার পানি ব্যবহার করতে হলেও এখন মন্ডল ফ্যাব্রিকসের প্রয়োজন পড়ছে ৮০ লিটার।
দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক ডিবিএল গ্রুপ জানিয়েছে, কারখানা আপগ্রেডেশনে ৮০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে তারা ২০১৬ সালের পর পানি ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পেরেছে।
গ্রুপটির সাসটেইনেবিলিটি প্রধান মোহাম্মদ জাহিদুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগে আমাদের এক কেজি কাপড়ে ১২০ লিটার পানি ব্যবহার করতে হতো। এখন একই পরিমাণ ফ্যাব্রিকের জন্য ৬০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়।'
অনন্ত অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শরীফ জহির জানান, এক জোড়া জিন্স ওয়াশে তারা পানির ব্যবহার ২৫০ লিটার থেকে ৫৫ লিটারে নামিয়ে এনেছেন।
পানিসাশ্রয়ী শিল্পকে কর রেয়াত, সরাসরি নগদ প্রণোদনা এবং সনদ প্রদানের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণে বিনিয়োগ উৎসাহিত করে অমূল্য সম্পদটির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব বলে পরামর্শ দেওয়া হয় গবেষণা প্রতিবেদনটিতে।
গবেষণায় বলা হয়, 'পানিসাশ্রয়ী অর্থায়নকে উৎসাহিত করতে সবুজ খাতের মতো কর হার কার্যকর করা উচিত।'
ক্রেতাদের কাছ থেকে পানির দাম নেওয়া এখনও দূরের বিষয়
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. খায়রুল ইসলাম জানান, অনেক দেশ পানির ছায়ামূল্য নিয়ে আলোচনা করলেও, আমদানি ও রপ্তানি বিলে সেই মূল্য যোগ করে না। তবে ভবিষ্যতে এই মূল্য সংযোজন একটি বড় বিষয় হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
'বিদেশি ক্রেতাদের কাছে এখনই বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের পানির মূল্য চাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে গণসচেতনতা বাড়াতে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক সম্পদের ছায়ামুল্য নির্ধারণ নিয়ে কথা বলতে হবে। এর গুরুত্ব সম্পর্কে ফ্যাশন শিল্প মালিক ও সাধারণ জনগণ সবাইকে সচেতন হতে হবে,' মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে ওয়ারপোর পরিচালক (পরিকল্পনা) ও পানির ছায়ামূল্য নির্ধারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, সচেতনতা তৈরির জন্য তারা এই বিষয়ে কাজ অব্যাহত রাখবেন।
তিনি বলেন, 'উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে পানির মূল্য আদায়ের কোনো পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত সরকারের নেই।'
ডিবিএল গ্রুপের কর্মকর্তা জাহিদুল্লাহ বলেন, ঢাকায় এবং কিছু রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে পোশাক প্রস্তুতকারকরা এখন সরকারকে কিছু পানির মূল্য পরিশোধ করে। আর নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে নলকূপ স্থাপনের জন্য কিছু ফি দিতে হয়।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, 'সরকার যদি আমাদের ওপর পানির দাম আরোপ করে, তাহলে আমরা পোশাক প্রস্তুতকারকরা চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। কারণ ক্রেতারা সবসময়ই কম দামে পণ্যের সোর্সিং পছন্দ করে।'
শরীফ জহির বলেন, পানির মূল্য নির্ধারণের ফলে আরও কম দামে পণ্য সরবরাহ নিয়ে দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারে।