কোভিড মোকাবেলায় সবকিছু খোলা রেখে বিধিনিষেধ আরোপ সাংঘর্ষিক: স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
ওমিক্রনের বিস্তার রোধে সরকার পরস্পরবিরোধী নীতি গ্রহণ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কারণ একদিকে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে; অথচ অন্যদিকে জনসমাগম হয় এমন সব জায়গা উন্মুক্তই রয়েছে।
বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে ২ হাজার ৯১৬ জন নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, যা গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ঢাকা ও রাঙ্গামাটিকে সংক্রমনের রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আগামী ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়বে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। অথচ এমন পরিস্থিতিতেও ঢাকায় বাণিজ্যমেলা চলছে, নির্বাচন হচ্ছে, স্কুল-কলেজ, শপিংমল, অফিস-আদালত-কলকারখানা সব চালু রয়েছে।
এরইমধ্যে বৃহস্পতিবার থেকে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন, রেস্তরাঁয় টিকা কার্ড দেখানোসহ ১১ দফা বিধিনিষেধ কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার।
তবে, সবকিছু খোলা রেখে ১১ দফা কার্যকরের বিষয়টি সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্য উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ডাঃ আবু জামিল ফয়সাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এখন বাণিজ্য মেলা, নির্বাচন সব চালু রেখে ১১ দফা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। জীবন-জীবিকার স্বার্থে লকডাউন না দিলে শতভাগ মাস্ক নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে হয়তো সংক্রমণ কমাতে যাবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জনপ্রতিনিধি সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।"
সংক্রমণের উচ্চ হারের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন প্রশ্নে বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, "আমরা সরকারকে সব ধরনের জনসমাগম ও সভাসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জনগণকে সচেতন করতে পারে, চিকৎসা দিতে পারে, সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারে; কিন্তু প্রতিকার তো স্বাস্থ্যবিভাগ করতে পারেনা। এসব বাস্তবায়নের জন্য অন্য মন্ত্রণালয় আছে।"
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ও কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন আমরা নির্দেশনা দিতে পারি, কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারিনা। এতেই বোঝা যাচ্ছে বিধিনিষেধ শুধু জারি করা হয়েছে, কে বাস্তবায়ন করবে তা নিশ্চিত করা হয়নি। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে কে টিকা কার্ড দেখবে তা স্পষ্ট করা হয়নি। আর সবকিছু খুলে রেখে অর্ধেক যানবাহনে চলাচল করলে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে শুধু, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা। সংক্রমণ পরিস্তিতি মারাত্মক রূপ নিচ্ছে; এখন শুধু নির্দেশনা জারি করলেই হবেনা, যৌক্তিকভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।"
বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে আরও চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়াও, সংক্রমণের হার বেড়ে হয়েছে ১১.৬৮ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সারাদেশে ২৪ হাজার ৯৬৪টি নমুনা পরীক্ষা করে এ ফলাফল পাওয়া যায়।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ১১১ জনে এবং মোট সংক্রমণ পৌঁছেছে ১৬ লাখ ১ হাজার ৩০৫-এ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) বুধবার মহামারির তীব্রতার ভিত্তিতে দেশের করোনভাইরাস আক্রান্ত জেলাগুলোকে তিনটি জোনে (লাল, হলুদ, সবুজ) ভাগ করেছে। এরমধ্যে কোভিড -১৯ ও ওমিক্রন ধরনের উচ্চ সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হারের কারণে ঢাকা ও রাঙ্গামাটি জেলাকে 'রেড জোন' বা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত সাত দিনে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের পর, মোট ছয়টি জেলাকে 'হলুদ অঞ্চল' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং আরও ৫৪টি জেলাকে 'সবুজ অঞ্চল'-এর অধীনে রাখা হয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে রাজধানীতে সংক্রমণের হার প্রায় ১২.৯০ শতাংশ এবং রাঙ্গামাটিতে ১০ শতাংশ।
দেশে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে ২০ হাজার বেডের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু রোগী যদি ৪০ হাজার বা এক লাখ হয় তাহলে তারা কোথায় থাকবে, এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, "প্রত্যেক দেশেরই একটি সক্ষমতার ব্যাপার আছে। যতই সক্ষমতা বাড়াই কোনটাই আনলিমিটেড নয়। সেদিকে খেয়াল রেখে আমাদের কাজ করতে হবে।"
বুধবার রাজধানীর মহাখালিতে এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, "আজ (বুধবার) সংক্রমণের হার ১১ শতাংশ, যা গতকালের চেয়েও ২ শতাংশ বেশি। গতকাল ছিল আড়াই হাজার রোগী, আজ তা তিন হাজারের কাছাকাছি। এর একটি অংশ হাসপাতালে আসবে। যদি ৫ শতাংশ কম রোগীও হাসপাতালে আসে, তারপরও রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এর ফলে আগামী ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। তখন আবার হাসপাতালে চাপ পড়বে, ডাক্তারদের ওপর চাপ বাড়বে, বেড পেতে সমস্যা হবে। মৃত্যুর হারও বেড়ে যাবে।"
দেশে করোনায় আক্রান্তদের ১৫ ভাগই ওমিক্রন ধরনে আক্রান্ত জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, "সংক্রমণ মোকালায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১১ দফা বিধিনিষেধ দিয়েছে। আগামীকাল থেকে তা বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। আগামীকাল থেকে সামাজিক-রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সেগুলো সীমিত পরিসরে ও বন্ধ করতে হবে। নিরুৎসাহিত করতে হবে। সব জায়গায় মাস্ক পরতে হবে।"
"যদি না পরে তাহলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হবে, জেল পর্যন্ত হতে পারে। দোকান-পাট ৮টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। মাস্ক না পরে কেউ যানবাহনে উঠবেন না। এছাড়া, এখন পর্যটনকেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে", তিনি আরও বলেন।
'লকডাউন কোনো সমাধান নয়, সামনে এগোতে হবে': এফবিসিসিআই প্রধান
এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিনের মতে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রোধে আরেকটি লকডাউন কোনো কার্যকর সমাধান হতে পারে না।
বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত 'মিট দ্য রিপোর্টার্স' অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, "আমরা এটি (লকডাউন) উদ্বেগজনক বলে মনে করছি, কারণ বিশ্বের কোনো দেশই লকডাউন জারি করে সফল হতে পারেনি।"
পাশাপাশি গণসচেতনতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সরকার এবার লকডাউনের পথে হাঁটবে না, এমন আশা প্রকাশ করে এফবিসিসিআই প্রধান বলেন, "লকডাউন কোনো সমাধান নয়। একটি দেশে যত বেশি লকডাউন দেওয়া হয়েছে, তত বেশি তার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। লকডাউনের কারণে কিছু দেশের প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে বলে জানা গেছে।"
এবার লকডাউনের মতো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, করোনভাইরাস মহামারির প্রথম দিকে দেশের পোশাক কারখানাগুলো প্রায় ১৩ থেকে ১৪ দিন বন্ধ ছিল; এর ফলস্বরূপ ১০ শতাংশ কর্মী হারাতে হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না করে, বরং বিকল্প পথ খুঁজে বের করা উচিত বলে মন্তব্য করেন এফবিসিসিআই সভাপতি। এছাড়া, স্পোর্টিং ফেস মাস্ক ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে পারে বলে জানান তিনি।
এসময় ডিআরইউ সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিব উপস্থিত ছিলেন।
বাসের ভাড়া এখনই বাড়ছে না
আজ থেকে গণপরিবহনগুলোতে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী বহনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবে, এখনই বাড়ানো হচ্ছে না বাসের ভাড়া।
বুধবার (১২ জানুয়ারি) স্টকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার এ তথ্য জানিয়েছেন।
সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ১৩ জানুয়ারি থেকে কর্তৃপক্ষকে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চালানোর নির্দেশ দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
নির্দেশনা ঘোষণার পরপরই বাস মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ দিতে শুরু করে। বিষয়টি সমাধানে বিআরটিএ গতকাল (১২ জানুয়ারি) বিকেলে সংশ্লিষ্ট স্টকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে ভাড়া না বাড়িয়ে অর্ধেক ধারণক্ষমতায় বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে, পূর্ণ ক্ষমতায় যাত্রী বহনের দাবি জানিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা বিদ্যমান ভাড়ায় অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চালাবেন।
বৈঠকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।